মমতার ইস্যু বাংলাভাষা, বাঙালি, বিজেপি-র বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা
২১ জুলাই ২০২৫কলকাতায় তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ''আগামী ২৭ জুলাই থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হবে। প্রতি শনি ও রোববার বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাবেন তৃণমূল কর্মীরা। ভোটের ফলপ্রকাশ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।''
বিজেপি-ও এদিন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তুলে বুঝিয়ে দিয়েছে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাদের প্রচারের অভিমুখ কী হবে।
ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রধান দুই প্রতিপক্ষের প্রচারে ছেয়ে থাকবে, বাংলাভাষা, বাঙালি, বঙ্গসন্তানদের মর্যাদা, বাংলাদেশ, পুশ ব্যাক ও রোহিঙ্গার মতো বিষয়গুলি।
মমতা বলেছেন, ''বাংলা ভাষlয় কথা বললেই বিজেপি শাসিত রাজ্যে আটক করা হচ্ছে। আমি স্পষ্টভাবে বলছি, বাঙালির উপর অত্যাচার হলে এই লড়াই দিল্লি পর্যন্ত যাবে।'' মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, ‘‘২৭ জুলাই নানুর দিবস থেকে প্রতি শনি ও রবিবার বাংলা ভাষার উপর আক্রমণের প্রতিবাদে মিটিং-মিছিল করুন। প্রতিবাদে নামুন। এ বার শুরু হলো ভাষারক্ষার শপথ। ''
মমতার ২১ জুলাইয়ের ভাষণে বাংলা ভাষা ছাড়া বারবার বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা, পুশ ব্যাক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। মমতা একটা কাগজ তুলে ধরে বলেছেন, ''আমার কাছে হিসাব আছে, হাজারো মানুষকে বাংলায় কথা বলার জন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যে আটক করেছে। আমি জানি না কতজনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে।'' আরেকটি কাগজ তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ''বিজেপি শাসিত রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকার গোপন নির্দেশ পাঠিয়ে বলেছে, একমাস পর্যন্ত মানুষকে ডিটেনশন শিবিরে রাখতে পারবে। এই বিজ্ঞপ্তি পশ্চিমবঙ্গে পাঠায়নি। তারপরই তিনি হিন্দিতে হুমকি দেন, আমি দরকার হলে আসাম যাবো। ওখানে গিয়ে আন্দোলন করবো। আমাকে পারলে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকাক।''
মমতার প্রশ্ন, ''বিশ্বে রোহিঙ্গার সংখ্যা কত? জাতিসংঘ বলছে, মোট ১০ লাখ রোহিঙ্গা অভিবাসী আছে, আপনারা কী করে বললেন ১৭ লাখ?''
আর রাজ্য বিজেপি তাদের টুইটার পেজে পোস্ট করে বলেছে, ধর্মতলায় একটা সার্কাস চলছে, সেখানে বাসে করে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা হচ্ছে।
এইভাবেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনি প্রচারের গোড়াতেই ঢুকে পড়েছে বাংলাভাষা, বাঙালি, বাংলাদেশ, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ।
মমতা যা বললেন
দিনকয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গে এসে বাংলায় কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, ভারতের কোথাও বাঙালিদের হেনস্থা করা হয় না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ''বাংলায় কথা বলার জন্য দেখুন কত লোককে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছে। খেলা আবার হবে। বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার খেলা, লক্ষ্মী বাঁচানোর খেলা, অন্য ভাষাকে সম্মান দেওয়ার খেলা। এই খেলা সকলকে নিয়ে খেলতে হবে। এবার একেবারে ছক্কা মেরে বোল্ড আউট করতে হবে। বিজেপিকে বোল্ড আউট, সিপিএমকে মহাশূন্যে পাঠাতে হবে। নির্বাচন এলে ওরা রাজবংশী, মতুয়াদের নিয়ে কথা বলে। আর মহারাষ্ট্রে মতুয়াদের উপর অত্যাচার হয়েছে। আসাম থেকে রাজবংশী মানুষকে ডেকে পাঠিয়েছে ফরেনার্স ট্রাইবুন্যাল।''
মমতা বলেছেন, ''আমি হিন্দি ভাষাকে ভালোবাসি। অন্য কোনো ভাষাকে অসম্মান করি না। কিন্তু বাংলাভাষার জন্য দরকারে আবার ভাষা আন্দোলন হবে।'' বস্তুত মমতার পুরো ভাষণই কেন্দ্রিত ছিল বাংলা ভাষা, বাঙালি ও বাংলা বাঁচাওয়ের উপরে। মমতা বারবার বলেন, ''আপনারা আরো বেশি করে বাংলায় কথা বলুন।''
প্রধানমন্ত্রীর নাম না করে তিনি বলেছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে এসে টেলিপ্রম্পটারে দেখে কয়েক লাইন বাংলা বললে কিছুই প্রমাণ হয় না। বাংলার মানুষকে যদি বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে লড়াইটা দিল্লিতে গিয়েও হবে। আমি ছেড়ে দেয়ার মতো মানুষ নই। বাংলা ভাষার উপর কেন সন্ত্রাস হচ্ছে?''
মমতার ঘোষণা, দিঘায় যেমন জগন্নাথধাম করেছি, তারই অনুকরণে দুর্গাঙ্গণ করবো।
'ইডি, সিবিআই নেই, আছে বাংলা ভাষা ও বাঙালি'
২১ জুলাইয়ের সমাবেশে ছিলেন ডিডাব্লিউ বাংলার সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষ। স্যমন্তক জানিয়েছেন, গত তিনটি ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে মমতা ও অভিষেকের ভাষণে বারবার শোনা যেত ইডি, সিবিআই, বিরোধীদের উপর প্রতিহিংসার রাজনীতির কথা। আর সোমবার মমতা ও অভিষেকের ভাষণে ইডি-সিবিআই প্রসঙ্গ প্রায় নেই। মমতার ভাষণ শুনে মনে হয়েছে, আগামী নির্বাচনে তার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হতে চলেছে, বাংলা ভাষা, বাঙালি, বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা, পুশ ব্যাক, ধরপাকড়ের মতো বিষয়গুলি। এই আবেগের তাস খেলেই মমতা আবার ক্ষমতায় আসতে চান।
ডিডাব্লিউর সাংবাদিক শময়িতা চক্রবর্তী বলেছেন, ''মমতা তার অভিযোগ প্রমাণ করতে গিয়ে দুটি কাগজ দেখিয়েছেন। বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার একটি গোপন বিজ্ঞপ্তি পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্যে পাঠিয়েছে। সেখানে কোনো মানুষকে এক মাস ডিটেনশন শিবিরে আটকে রাখার কথা বলা হয়েছে। এভাবে তিনি তার অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা বুঝিয়েছেন।''
প্রতিবাদ সাহিত্যিকদের
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক প্রচেত গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমি কোনো রাজনীতি করি না। কিন্তু আমি জানি, বিশ্বাস করি ও মানি, বাঙালি হিসাবে বাংলা ভাষা আমার গর্বের ভাষা, আমার অন্ন জোগানোর ভাষা, আমার মাথা উঁচু করে থাকার ভাষা। কোনো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে এই ভাষার উপর আক্রমণের নিন্দা করি এবং সমস্ত সুস্থ মানুষই তা করবেন। যে কোনো ভাষার উপর আক্রমণেরই আমি নিন্দা করি।''
প্রচেত জানিয়েছেন, ''বাংলা ভাষা আমার বেঁচে থাকা, আমার প্রতিবাদ, আমার মর্যাদা। এই ভাষার উপর আক্রমণ হলে প্রতিবাদ করবোই।''
লেখিকা সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমার মনে হয়, এর মূলে আছে এনআরসি, অনুপ্রবেশকারী নিয়ে রাজনীতিতে ফেরা। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই রাজনীতিতে ফিরে না গিয়ে বলা যায়, একটা ভাষায় কথা বলার জন্য একজনকে তদন্তের মুখে পড়তে হচ্ছে। তাকে বলা হচ্ছে, কাগজ দেখাও। বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য এই অবস্থায় তাকে পড়তে হচ্ছে।
সম্রাজ্ঞীর মতে, ''এক্ষেত্রে দুটো জিনিস হয়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলেন। তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি, যারা এটা করছেন, তারা মনে করেন, কোনো অনুপ্রবেশকারীকে এভাবে তারা চিহ্নিত করতে পারবেন। কিন্তু কোনো ভাষা বললে যদি প্রমাণ করতে হয়, আমরা এই দেশের নাগরিক, তখন ভাষাটা প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে ওঠে। বাংলা বললে তো একটা শাস্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। তখন আমার প্রথম চেষ্টা হবে, নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্য ভাষায় কথা বলবো। তাহলে ব্যক্তির উপর শাস্তির মধ্যে দিয়ে ভাষার উপর অপমান করা হচ্ছে। আমাদের প্রাথমিক অপরাধ কি, আমরা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলছি। বাংলা ভাষায় কথা বলছি বলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।''