ভারতে এখন ৪৫টি সংগঠন নিষিদ্ধ৷ এগুলি মূলত জঙ্গি সংগঠন৷ এই তালিকায় বব্বর খালসা, খালিস্তান কম্যান্ডো ফোর্স, লস্কর-ই-তইবা, জৈশ-ই-মোহাম্মদ, হরকত-উল-মুজডাহিদিন, হিজবুল-উল-মুজাহিদিন থেকে শুরু করে এলটিটিই, অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্স, সিমি, আল কায়দা, অখিল ভারত নেপালি একতা সমাজ, খালিস্তানি লিবারেশন ফোর্স পর্যন্ত ৪৫টি সংগঠন আছে৷ বেআইনি কার্যকলাপ রোধ আইন অনুসারে এদের নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ভারতে অতীতেও খুব সামান্য কয়েকবার করা হয়েছে৷ তবে অনেকগুলি সংগঠন অতীতেও নিষিদ্ধ হয়েছে৷ অতীতে পশ্চিমবঙ্গে ও কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওবাদী) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী, লেনিনবাদী) পিপলস ওয়ার এখনো নিষিদ্ধ আছে৷ তবে তারা গণতান্ত্রিক পথে চলে না, বরং তারা সহিংস পথে বিপ্লবের চেষ্টা করে৷
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করার পর বিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ সেই তালিকায় ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, অরুণ জেটলি, বিজয়রাজে সিন্ধিয়া, মুলায়ম সিং যাদব, চরণ সিং, জর্জ ফার্নান্ডেজ, রাজ নারায়ণসহ অনেক নেতা৷
জরুরি অবস্থার সময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও জামাত-ই-ইসলামিকে৷ জরুরি অবস্থার অবসানের পর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়৷ আরএসএস অবশ্য প্রথমবার নিষিদ্ধ হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর৷ তখন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়ানোর শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও এম এস গোলওয়ালকরকে সর্দার প্যাটেল জানিয়েছিলেন, কেন আরএসএসকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
ঘটনা হলো, ভারতে রাজনৈতিক দল বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হলেও তার মেয়াদ বেশিদিন থাকেনি৷ পশ্চিমবঙ্গে বিধানচন্দ্র রায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করলেও পরে তা তুলে নেওয়া হয়৷ ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম নির্বাচনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে৷ শুধু তাই নয়, ১৯৫৪ সালে একবার বিধানচন্দ্র রায়ের পুলিশ একবার জ্যোতি বসুকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল৷ জ্যোতিবাবু সোজা বিধানসভায় গিয়ে স্পিকারকে বলেন, বিধানসভা সরকারের এলাকা নয়, স্পিকারের এলাকা৷ তিনি যেন তাকে আশ্রয় দেন৷ সাতদিন জ্যোতিবাবু সেখানে ছিলেন৷ সেজন্য স্পিকার শৈল মুখোপাধ্যায়কে বিধানচন্দ্র রায় বা কংগ্রেসের অন্য কেউ কিছু বলেননি৷
আরএসএসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও ১৯৪৯ সালের ১১ জুলাই তুলে নেয়া হয়৷ গান্ধীজি হত্যার পর নিষিদ্ধ হওয়ার মাস ১৭-র মধ্যেই সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়৷ জরুরি অবস্থার পর যেমন প্রত্যাহার করা হয় আরএসএসের উপরে নিষেধাজ্ঞা৷
এখনে একটা কথা বুঝে নেয়া দরকার৷ কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা এবং কোনো জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার মধ্যে আসমান জমিন ফারাক আছে৷ কোনো জঙ্গি সংগঠন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সহিংসতা করছে, তাদের হাতে মানুষ মারা যাচ্ছে, বিশ্বের কোনো দেশই তা বরদাস্ত করে না, করবেও না৷ তাই প্রতিটি দেশই প্রচুর এরকম সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে৷
কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দল, তারা যদি সংবিধান মেনে চলে, সশস্ত্র পথে না চলে, তাহলে ভারতে অন্তত তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় না বা বলা ভালো এতদিন হয়নি৷ কমিউনিস্ট পার্টিকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, তখন তারা বিপ্লবের পথে ব্যবস্থা বদলের কথা বলত ও সেই দিকে কাজ করার চেষ্টা করত৷ পশ্চিমবঙ্গে যখন কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তখনো তাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সায় ছিল না৷ কিন্তু বিধানচন্দ্র রায় তাকে বলেন, কমিউনিস্টরা যে অস্থিরতা তৈরি করছে, তাতে তিনি কাজ করতে পারছেন না৷ তারপর তিনি কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ করেন৷ নেহরু কিন্তু গোটা ভারতে তাদের নিষিদ্ধ করেননি৷
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তো অনেক কিছুই বদলেছে৷ তবু ভারতে কোনো স্বীকৃত দলকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা তেমন নেই৷ পরবর্তীকালে মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত দলগুলি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ কিন্তু সেটাও তাদের মতাদর্শগত অবস্থান ও সহিংস পথ নেয়ার জন্য৷
ভারতে নাটক, সিনেমা, বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা প্রচুর ঘটেছে এবং ঘটছেও৷ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দলগুলি একে অপরকে বিন্দুমাত্র জায়গা ছাড়ে না৷ তবে তারা পুরনো শত্রুতা ভুলে এক হয়৷ যেমন হয়েছে কংগ্রেস ও ডিএমকে, যেমন জর্জ ফার্নান্ডেজ, নীতীশ কুমার, রামবিলাস পাসোয়ান, চন্দ্রবাবু নাইডুর দল বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে৷ কেন্দ্র ও রাজ্যে বহুবার পটপরিবর্তন হয়েছে৷ জরুরি অবস্থার ভয়ংকর বাড়াবাড়ি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার পরেও জনতা পার্টি ক্ষমতায় এসে কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি৷ ভোটদাতারা কংগ্রেসকে শাস্তি দিয়েছে৷ ইন্দিরা গান্ধীকে প্রথম সুযোগে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে দিয়েছে৷ আবার সেই ইন্দিরার বিরুদ্ধে যখন জনতা পার্টি সরকার প্রতিশোধমূলক আচরণ করলো, নিজেরা সমানে ঝগড়া করে সরকারের অস্তিত্ব সংকট করে দিলো, তখন তারাই আবার ইন্দিরাকে ক্ষমতায় এনেছে৷
একই ঘটনা ঘটেছে ২০০৪ সালে৷ যখন বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সরকার গঠন নিয়ে এনডিএ নিশ্চিত ছিল, তখন ভোটদাতারা ক্ষমতায় নিয়ে এলো কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-কে৷ আবার দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত ইউপিএ-কে ২০১৪ তে সরিয়ে দিয়ে তারা ক্ষমতায় এনেছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি-কে৷ তারপর যখন মনে হচ্ছিল, ভারত এবার কংগ্রেস-মুক্ত হবে, তখন আবার গত লোকসভা নির্বাচনে তাদের ৯৯টি আসন উপহার দিয়েছেন ভোটদাতারাই৷ ফলে ভারতে কোনো দলকে ওইভাবে নিষিদ্ধ করার দরকার হয়নি, শাস্তি দিতে হলে ভোটদাতারাই দিয়েছেন, একেবারে গণতান্ত্রিক পথে৷