ভারতে বিমানবন্দরের কাছে উঁচু বাড়ি ভেঙে দেয়া হবে
১৯ জুন ২০২৫গুজরাটের আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান ভেঙে পড়ে ২৪১ জন মারা গিয়েছেন। বিমানটি টেকঅফ করার এক মিনিটের মধ্যে অদূরে একটি ভবনে ভেঙে পড়ে। তারপরেই বিশেষ সর্তকতা জারি করেছে এএআই যা কলকাতাকেও মেনে চলতে হবে। সারা ভারতে এই নির্দেশিকা কার্যকর হবে। যে সব বাড়ি নির্দিষ্ট উচ্চতার বেশি, সেগুলিতে বাড়তি অংশ ভেঙে দেয়া হবে।
ভবনের জন্য নির্দেশিকা
এয়ারপোর্ট অথরিটির নির্দেশিকা আসার পরে তৎপর হয়েছে কলকাতা পুরসভা। এই পুর এলাকা কয়েকটি বরোতে বিভক্ত। পুর কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক বরোর এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারদের নির্দেশ দিয়েছে, এএআই ভবনের উচ্চতা সংক্রান্ত যে নির্দেশিকা পাঠিয়েছে, তা যেন কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।
বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুরসভাকে যে নির্দেশিকা পাঠিয়েছে এএআই, সেখানে তারা একটি মানচিত্রের মাধ্যমে ভবনের বিন্যাস তুলে ধরেছে। কালার কোডেড জোনিং ম্যাপ দেয়া হয়েছে পুরসভাকে, যেখানে নির্দিষ্ট রঙের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে বিমানবন্দরের আশপাশে এলাকায় বাড়ির উচ্চতা কতটা থাকতে পারে। যে বাড়ির উচ্চতা নির্ধারিত সীমার বেশি হবে, তার জন্য এয়ারপোর্ট অথরিটির কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিতে হবে।
পুরসভার সূত্রের খবর, ভবনের উচ্চতা সংক্রান্ত নির্দেশিকা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে মূলত দমদম-কাশীপুর এলাকায়, যেটি কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে। মূলত বিমানবন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অর্থাৎ ফানেল এলাকায় ভবন পাঁচ থেকে ছয় তলা বেশি হলেই তা নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এই ব্যাসার্ধের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার নিউ ব্যারাকপুর মধ্যমগ্রাম, বিরাটি, অন্যদিকে রয়েছে বাগুইআটি, নিউটাউন। এখানে অনেক বহুতল গড়ে উঠেছে।
অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক এই সংক্রান্ত খসড়া বিল তৈরি করেছে। বিলে বলা হয়েছে, যদি বিমানবন্দরের আশেপাশে এমন ভবন থাকে, তবে তার মালিককে নোটিস পাঠানো হবে। তাকে ভবনের প্ল্যান থেকে শুরু করে উচ্চতা সংক্রান্ত তথ্য ৬০ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে। এই নির্দেশ অমান্য করলে ভবন ভাঙার মতো কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে কর্তৃপক্ষ।
এক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরে বাধার তৈরি হতে পারে। সেটা আঁচ করে পুরসভা ও জেলা প্রশাসনকে এই কাজের সঙ্গী করবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। কোনো বাধা এলে তা জানানো হবে জেলা প্রশাসনকে। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নির্ধারিত সীমার উঁচু ভবন ভেঙে ফেলা হবে, গাছ থাকলে কেটে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। তবে সরকারি নির্দেশিকা জারির পরে উচ্চতার সীমা লংঘন করে কোনো ভবন তৈরি হলে সেজন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না।
বাগুইহাটির এক বাসিন্দা রাজীব সরকার অনেকদিন আগেই উঁচু ভবন নিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি চিঠি লেখেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনকে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন চিঠি লিখে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে বিধাননগর পুরসভা, দক্ষিণ দমদম পুরসভা, বিধাননগর কমিশনারেটকে। কিন্তু সেই কাজ খুব একটা এগোয়নি। আমেদাবাদের ঘটনার পর আবার গোটা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
পাখি, বাজার ও ভ্যাট
শুধু ভবন নয়, বিমানবন্দরের ফানেল এলাকার মধ্যে পাখির ওড়াউড়ি সমস্যা তৈরি করে। বেশি উচ্চতার গাছও বিপজ্জনক। বাজার ও ভ্যাটের ক্ষেত্রেও সতর্কতা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এয়ারপোর্ট অথরিটির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বিমানবন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রেও অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া এসব এলাকায় যে খোলা বাজার ও ভ্যাট রয়েছে, তার জন্য পাখির আনাগোনা বাড়ছে।
কলকাতা বিমানবন্দরের লাগোয়া বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উপরে রয়েছে অতিকায় ভ্যাট বা আবর্জনা ফেলার জায়গা। বরানগর এলাকার এই ভ্যাটে একাধিক পুরসভার বর্জ্য জমা হয়। এর উপরে খাবারের খোঁজে পাখির দল ভিড় করে। বিশেষত শকুনের মতো পাখি এই দলে থাকে যারা ২০ হাজার ফুট উচ্চতাতেও উড়তে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এমন ভ্যাট বিমানবন্দরের এত কাছে তৈরি করা হলো?
একই ধরনের সমস্যা আছে খোলা বাজারের ক্ষেত্রে। বাজারে যদি আচ্ছাদন থাকে, তাহলে পাখির আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। বাজারের উপরে পাখি প্রতিনিয়ত ঘোরাফেরা করে খাবারের খোঁজে। ফানেল এলাকার মধ্যে এই বাজারও উড়ানের পক্ষে অনুকূল নয়। বিশেষত দমদম ও বাগুইআটির মতো অত্যন্ত বেশি জনঘনত্ব সম্পন্ন এলাকায় অনেকগুলি বাজার রয়েছে। অনেক সময়েই রাস্তার ধারে অস্থায়ী বাজার বসে যায় যেখানে কোনো ছাউনি থাকে না।
দমদম পুরসভার উপ পুরপ্রধান বরুন নট্ট ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনার আগেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ভ্যাট এবং বাজার নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এইচএমভি এলাকায় ভ্যাট আমরা এখন তুলে দিয়েছি। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের ডাম্পিং গ্রাউন্ড অনেক পুরসভাই ব্যবহার করে। বরানগর এলাকার মধ্যে এই গ্রাউন্ড পড়ে। পাঁচটা পুরসভা মিলে এই আবর্জনা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবছি। মেট্রোরেলের কাজের জন্য বাজারের শেড ভাঙা হয়েছিল। আমাদের পুরসভা এবং বাজার কমিটি মিলে এই শেড করবে। এখন ত্রিপল টাঙিয়ে বাজার বসছে।"
কলকাতা পুরসভার সাবেক মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা একটা সময়ে ফাঁকা ছিল। বিরাটি, মধ্যমগ্রাম অনেক পরে উন্নত হয়েছে, আরো পরে রাজারহাট। রানওয়ে লাগোয়া যশোর রোডের ধারে নির্মাণ হয়েছে। আজ থেকে তিন দশক আগে জনবসতি কম ছিল এসব এলাকায়। বহুতলও প্রায় ছিল না বলা চলে। বিমানবন্দরও এতটা ব্যস্ত ছিল না তখন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনবসতি বেড়েছে, ব্যস্ত হয়েছে বিমানবন্দর। কিন্তু সব নির্মাণ নিয়ম অনুসারে হয়নি। তাই আজকের পরিস্থিতি।"
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিমানের পথ বাধামুক্ত হওয়া উচিত।সেখানে নির্মাণ কাঠামোয় এমন কিছু থাকা উচিত নয় যে বিমানের রান অফ বা টেক অফের ক্ষেত্রে বিমান চালকদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। বিমানবন্দরগুলো তৈরির সময় শহরের একেবারে প্রান্তে বা উপকন্ঠের জনমানবহীন অঞ্চল বেছে নেয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেগুলো উত্তরোত্তর নগরায়নের ফলে শহরের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।। বিমানবন্দরের পাশাপাশি জমির দাম বেড়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, বহুতলের সারি তৈরি হচ্ছে। এগুলো সমস্ত কিছুই যে বিমানের উড়ানের নিরাপত্তাকে ব্যাহত করতে পারে, সেটা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, "দুই পক্ষ এজন্য দায়ী। রাজ্য সরকার বা স্থানীয় পুরসভার যেমন বিষয়টি দেখার দায় রয়েছে, তেমনি বিমান সুরক্ষা নিয়ে ডিজিসিএ (ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন) নিজের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। এত বড় একটা ঘটনার পরে সব পক্ষের টনক নড়েছে।"
তবে উপায় কী? তিনি ব্যাখ্যা করেন, "এই বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর এবং উদ্যোগী হতে হবে। বিমানবন্দরকে ঘিরে একটা এলাকা ভাবা উচিত যেখানে উচ্চতার বিধিনিষেধ দেখানো আছে। এটুকুই যথেষ্ট নয়। যেভাবে খোলা বাজার বসানো হয়েছে, তাতে পাখির উৎপাত দ্রুত বেড়েছে। বাজারগুলোকে ঢাকা উচিত, সম্ভব হলে বাজার অন্যত্র বসানো উচিত। ডাম্পিং গ্রাউন্ড থাকলে সেটাকেও অন্যত্র সরাতে হবে। এয়ারপোর্ট এলাকায় পাখির ঝাঁক আসা-যাওয়া করে। তাই এসব সরাতে হবে উড়ান সুরক্ষার স্বার্থে। কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারকেই কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে মানুষের নিরাপত্তায়।"
পরিবেশ সাংবাদিক জয়ন্ত বসু ডিডাব্লিউকে বলেন, "ভারত সরকার রাজ্যসভায় বছর দুয়েক আগে যে তথ্য দিয়েছে, সেটা থেকে স্পষ্ট, ২০১৮ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে পাঁচ বছরে দেশে বিমানবন্দরগুলি থেকে যে বিমান ওঠানামা করে সেখানে পাখির ধাক্কা থেকে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে মনে করছেন যে, আমেদাবাদে যে সাম্প্রতিক বিপর্যয় হয়েছে তাতে পাখির ধাক্কার ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। এই সংখ্যাটা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। এক্ষেত্রে সংখ্যার বিচারে দিল্লি সবচেয়ে এগিয়ে থাকলেও তার পরে রয়েছে আমেদাবাদ। কলকাতার অবস্থাও খুব নিরাপদ নয়।"
কলকাতা বিমানবন্দরের ব্যাপারে তিনি বলেন, "বস্তুত যতগুলো মেট্রো শহর আছে, তার মধ্যে কলকাতায় পাখিজনিত প্রতিবন্ধকতার সংখ্যা খানিকটা কমের দিকে হলেও কলকাতায় এই প্রবণতা বৃদ্ধির হার খুব বেশি। অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে কলকাতায় যে সংখ্যায় পাখির ধাক্কা বেড়েছে, সেটা যথেষ্ট চিন্তাজনক। এক্ষেত্রে বিমানবন্দরের যে নিয়ম আছে, তা শুধু কলকাতা নয়, ভারতের অনেক বিমানবন্দরেই এই নিয়ম মানা হয় না।"
তার ব্যাখ্যা, "বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, তারা বিমানবন্দরের ভেতরে নানা ভাবে চেষ্টা করলেও বাইরে তাদের খুব একটা ভূমিকা নেই। এ নিয়ে একটা বিমানবন্দরের পরিবেশ সুরক্ষা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তাতে রাজ্য সরকারের দপ্তর থেকে পুরসভার উচ্চপদস্থ অফিসাররা আছেন, এমনকী বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষও আছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজের কাজ হয় না। রাতারাতি কিছু করা যাবে না। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে আশেপাশের পুরসভার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।"