শ্রমিকদের সংখ্যার নিরিখে ভারত হলো বিশ্বের একেবারে উপরের সারিতে থাকা দেশ। চীন ছাড়া আর কেউ শ্রমিকদের সংখ্যার নিরিখে ভারতকে টেক্কা দিতে পারবে না। এহেন ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। আর অসংগঠিত ক্ষেত্র, মানে সেখানে না আছে কোনো নিশ্চয়তা, না আছে সময়ের হিসাব, না আছে শ্রম অধিকারের পালন। সংগঠিত ক্ষেত্রেও এখন যেখানে এই সব অধিকার নেই বললেই চলে, সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রের হাল কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
ভারতের শ্রম মন্ত্রণালয় ই-শ্রম বলে একটা পোর্টাল খুলেছে। সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নথিভুক্ত করতে বলা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত ৩০ কোটিরও বেশি শ্রমিক সেখানে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। তার থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংখ্যার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এমন নয়, ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ৩০ কোটি শ্রমিক আছেন। সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।
কিন্তু এখান থেকে যেটা বোঝা যাচ্ছে, তা হলো, কোন ক্ষেত্রে কত শ্রমিক আছেন। নথিভুক্ত ৩০ কোটির মধ্যে ১৬ কোটির বেশি শ্রমিক আছেন কৃষিক্ষেত্রে, দুই কোটি ৮৯ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন গৃহকর্মী হিসাবে। দুই কোটি ৭৮ লক্ষ নির্মাণ ক্ষেত্রে, দুই কোটি শ্রমিক পোশাক ক্ষেত্রে, গাড়ি শিল্পির সঙ্গে ৮২ লাখ, চামড়ার সঙ্গে ৬০ লাখ, পর্যটনের সঙ্গে ৪১ লাখ শ্রমিক যুক্ত আছেন।
এই যে বিপুল সংখ্যায় শ্রমিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। চাষের মরসুমে পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে দক্ষিণের রাজ্য এমনকি কাশ্মীরেও দলে দলে শ্রমিক যান। সেখানে তাদের প্রাপ্য শুধু ন্যূনতম মজুরি, সেটাও একেক রাজ্যে একেক রকম। সেখানে কাজের সময় বলে কিছু নেই। এখন তো কাজের সময় বিষয়টিই উঠে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে অনেক লড়াই করে আট ঘণ্টার কাজ করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এখন বেসরকারি ক্ষেত্র দেখুন, কাজের সময় নেই। আট থেকে সেই সময়টা দশ ঘণ্টা, বারো ঘণ্টা বা তারো বেশি হয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, বিপিও শুধু নয়, অনেকগুলি ক্ষেত্রেই এই অবস্থা। ফলে সংগঠিত হোক বা অসংগঠিত, কোথাও আর কাজের ঘণ্টার হিসাব থাকে না। বাড়তি কাজের জন্য কোনো ওভারটাইম দেয়া হয় না। কিছু বলতে গেলেই সোজা বলে দেয়া হয়, দরজা খোলা আছে। চলে যাও। সাংবাদিক হোক বা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, কৃষিক্ষেত্রের শ্রমিক হোক বা গাড়ির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক, সব ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। সবজায়গায় প্রায় প্রতিদিন নির্মমভাবে কর্মী ছাঁটাই করা হয়।
একসময় শ্রমিক অধিকার নিয়ে অনেক বিতর্ক হতো, আন্দোলন হতো, বিক্ষোভ হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসবও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মতো বিরল হয়ে গেছে। ভারতে একসময় শ্রম ইউনিয়নগুলিতে বামপন্থিদের আধিপত্য ছিল। কিন্তু বামপন্থি দলের মতো শ্রম আমন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের ইউনিয়নের প্রভাবও ভয়ংকরভাবে নিম্নমুখি। এখন ভারতের এক নম্বর শ্রম সংগঠন হলো সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ। বামপন্থি হোক বা কংগ্রেসের আইএনটিইউসি বা ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ শ্রমিকদের নিয়ে যে খুব বেশি আন্দোলন করে তা নয়। যত দিন যাচ্ছে, তত এই শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ক্রমশই তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। অথচ, এখন শ্রমিকদের তাদের আরো বেশি করে দরকার ছিল।
দিল্লিতে সকালে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরলে একটা ছবি চোখে পড়বে। বেশ কিছু শ্রমিক কাজের খোঁজে রাস্তার পাশে ফুটপাথে অপেক্ষা করছেন। কারো হাতে ঘর রং করার ব্রাশ, কারো হাতে রাজমিস্ত্রির সামগ্রী, কারো হাতে অন্য কিছু। তারা যে কাজ পান তাই করেন। দৈনিক কত অর্থ পাবেন তা নির্ভর করছে, যিনি সেই কাজ দিচ্ছেন তার উপর। যেখানে চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি, সেখানে অনেকে কাজ পান না। পেলেও যে কোনো দামে করতে বাধ্য হন। এই ছবিটা ভারতের সর্বত্র। শ্রমিকদের অধিকার, তাদের নিরাপত্তা, কাজের পরিবেশ এসব নিয়ে কথা বলা তাদের স্বপ্নেও আসে না। বিশ্বের সব জায়গায় ভারতের পরিচিতি, এখানে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়, দক্ষ ও অদক্ষ যাই হোক না কেন, সবই সস্তায় পাওয়া যাবে, ৩৬৫ দিনই সেখানে সেল চলে।
করোনার দিনগুলির কথা মনে আছে? সেসময় ভারত দেখেছিল, বিভিন্ন রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে নিজের বাড়ি ফেরার চেষ্টা। খাবার না পেয়ে, জলতেষ্টায়, পথশ্রমে কত মানুষ হাহাকার করেছেন। তা নিয়ে প্রবল হইচইয়ের পরও কি অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে? বোধহয় না।
২০২৪ সালে অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, শ্রমের বাজারে মূল সূচক লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট (এলএফপিআর) বা শ্রমের বাজারে যোগদানের হার বেড়েছে, এবং আনএমপ্লয়মেন্ট রেট বা বেকারত্বের হার কমেছে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, এর পিছনে আছে স্বনিযুক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি। আনন্দবাজারে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, ''দেশে কাজের সার্বিক গুণগত মান কমেছে। যদিও কর্মসংস্থানের সার্বিক হার বেড়েছে, সেই কাজ তৈরি হয়েছে পারিবারিক অবৈতনিক শ্রমিক হিসাবে— যেমন, পরিবারের মালিকানাধীন মুদিখানায় কর্মী হিসাবে। যাঁরা স্বনিযুক্ত হিসাবে নিজেই কাজ করেন, পারিবারিক সদস্য ছাড়া অন্য কোনও শ্রমিক নিয়োগ করেন না— যেমন চা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি— দেশের কর্মরত জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতই সর্বাধিক, প্রায় ৩৫%৷’’
সংখ্যাতত্ত্ব সম্পর্কে ইংরেজিতে একটা কথা আছে, 'লাই, ড্যাম লাই অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স'। তাই সংখ্যার হিসাব আমাদের প্রকৃত ছবির কাছে নিয়ে যাবে না। ভারতে এখন শ্রম আইন অনেক লঘু করে দেয়া হয়েছে। ভারতের জিডিপি বাড়ছে, ভারত কিছুদিনের মধ্যে তৃতীয় অর্থনীতির দেশ হবে, এ সবই ঠিক, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক, এই ঘটনা দিয়ে ভারতের শ্রমিকদের দুরবস্থা ঢাকা যাবে না৷
শ্রমিকদের জন্য আইন আছে, তাদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি কত হবে সেসব নিয়ম আছে, তাদের জন্য একশ দিনের প্রকল্প আছে, কিন্তু একইসঙ্গে তার মধ্যে রাজনীতি আছে, দুর্নীতি আছে, কাটমানির অভিযোগ আছে, কাজ না পাওয়ার কাহিনি আছে, ন্যূনতম মজুরি না পাওয়ার বাস্তবতা আছে, সব মিলিয়ে ভারতে বিপুল সংখ্যক দিন আনি দিন খাই শ্রমিক এভাবেই কাজ করে চলেছেন৷