কারো বাড়িতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনী পাওয়া গেলে ওই ব্যক্তিকে গান্ধীবাদী বলে ধরে নেওয়া যায় না। এক যুগ আগে সুপ্রিম কোর্টে এক হাই প্রোফাইল মামলায় এই কথাগুলি বলেছিল বিচারপতি এইচএস বেদী এবং বিচারপতি সিকে প্রসাদের বেঞ্চ। মামলাটিতে আসামীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন প্রবাদপ্রতীম আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ রাম জেঠমালানি।
২০০৭ সালে বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী বিনায়ক সেনকে গ্রেপ্তার করে ছত্তিশগড় সরকার। যা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। প্রশাসনের অভিযোগ ছিল, বিনায়ক সেন মাওবাদীদের সাহায্য করছেন। তিনি মাওবাদীদের হয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে মধ্যস্থতা করছেন। নানাভাবে মাওবাদীদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছেন।
বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী বিনায়ক সেনের বিরুদ্ধে ‘Unlawful Activities (Prevention) Act’ বা ইউএপিএ ধারায় মামলা করা হয়। আজকের প্রতিবেদনে এই আইনটি নিয়েই মূলত আলোচনা করা হবে। কারণ, ভারতের অন্যতম বিতর্কিত আইন হিসেবে পরিচিত এই ইউএপিএ।
ফেরা যাক বিনায়ক সেনের কাহিনিতে। ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ছত্তিশগড় হাইকোর্টে বিনায়ক সেনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ছত্তিশগড়ের বিজেপি সরকার বিনায়ক সেনকে কার্যত 'সন্ত্রাসী' হিসেবে চিহ্নিত করে। সে সময় পার্লামেন্টে বিজেপির অন্যতম দোর্দণ্ডপ্রতাপ এমপি রাম জেঠমালানি। রাম জেঠমালানিকে ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উকিলদের মধ্যে একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই জেঠমালানি এগিয়ে আসেন বিনায়ক সেনের হয়ে লড়তে। সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। আর সেই শুানিতেই বিচারপতি এইচএস বেদী এবং বিচারপতি সিকে প্রসাদের বেঞ্চ মন্তব্য করেছিল-- কারও বাড়িতে গান্ধীর জীবনী থাকার অর্থ সেই ব্যক্তি গান্ধীবাদী এমনটা মনে করার কারণ নেই। উল্লেখ্য, নাবিয়ক সেনের বিরুদ্ধে যে তথ্যপ্রমাণগুলি আদালতের সামনে রাখা হয়েছিল, তা ছিল খানিক এমনই। তার বাড়িতে মাওবাদী বই পাওয়া গেছে গোছের সওয়াল করেছিল সরকারপক্ষ। শেষপর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বিনায়ক সেনের জামিন মঞ্জুর করে কোনো কারণ না দেখিয়েই। কেন বিনায়ক সেনের মতো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলো তা নিয়েও রীতিমতো প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছিল সরকারপক্ষকে।
বিনায়ক সেন জামিন পাওয়ার পর জেঠমালানি বলেছিলেন, ''বিশেষ করে এই মামলাটি লড়তে পেরে আমি অত্যন্ত খুশি। আদালতের নির্দেশেও আমি খুব আনন্দিত।''
ষাটের দশকে তৈরি হওয়া ইউএপিএ আইনে বেশ কয়েকবার সংশোধন আনা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধন হয়েছে ২০১৯ সালে। কিন্তু প্রথম থেকেই এই আইন নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, এই আইন তৈরি হয়েছিল দেশের ভিতর জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য। বস্তুত, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল এই আইন। কিন্তু আইনে কখনোই সন্ত্রাসীর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা তৈরি করা যায়নি। ফলে বার বারই দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে এই আইন ব্যবহার করেছে। ইচ্ছেমতো জেলে ঢোকানো হয়েছে প্রতিবাদীদের। ডক্টর বিনায়ক সেন, ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, প্রফেসর জিএন সাইবাবা, শারজিল ইমাম, স্ট্যান স্বামী এমনকী অরুন্ধতী রায়ের নামেও এই আইনে মামলা হয়েছে। অরুন্ধতীকে বাদ দিলে বাকি সকলকেই এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি রিপোর্টে বলেছে, ইউএপিএ-তে বিপুল পরিমাণ অ্যাক্টিভিস্ট বা সমাজকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কোনোরকম বিচার ছাড়া দিনের পর দিন জেলে কাটাচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকেই। বস্তুত, বিনায়ক সেনের জন্য রাম জেঠমালানির মতো আইনজীবী লড়তে না নামলে সেই মামলাও দিনের পর দিন ঝুলে থাকতো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ২৪ হাজার ১৩৪ জনকে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ২১২ জনকে দোষী প্রমাণিত করা গেছে। ৩৮৬ জন ইতিমধ্যেই আদালতের রায়ে মুক্তি পেয়েছেন। অর্থাৎ, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাকিরা এখনো বিচারের আওতায় আসেননি। অর্থাৎ, যতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ দোষী প্রমাণিত হয়েছে।
এই কারণেই এই আইনটিকে কালো আইন বা বিতর্কিত আইন বলে দাবি করেন কেউ কেউ। উল্লেখ্য, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, জামিন পাওয়া ভারতীয় আইনের একটি নিয়ম। এটি কোনো ব্যতিক্রম নয়। ইউএপিএ মামলাতেও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরও জামিন পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এমন ধারা লাগানো হচ্ছে যে জামিন দেওয়া যাচ্ছে না। এই ধরনের মামলাগুলি যাতে আরো দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, তা দেখতে হবে।
ইউএপিএ-তে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে রাষ্ট্র, তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হচ্ছে। বিনায়ক সেনের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ আনা হয়েছিল। একই অভিযোগ করা হয়েছিল ভারভারা রাওদের বিরুদ্ধে। বাস্তবে এই অভিযোগগুলির সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে বিভিন্ন মহল। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, নিছক সংকীর্ণ রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে মামলা রুজু করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে বেশ কিছুদিন তাকে জেলে ভরে রাখা যায়।
২০১৯ সালে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে সংশোধনী এনেছে এই আইনে। সেখানে গ্রেপ্তারির পরিসীমা আরো ব্যাপক করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। ফলে বিতর্ক কমার বদলে আরো বেড়েছে। রাম জেঠমালানির মতো আইনজীবীরা মনে করেন এই আইন আসলে বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে।
ভারতে এমন বিতর্কিত আইন আরো আছে। সাম্প্রতিক অতীতে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী এবং ওয়াকফ আইনের সংশোধনী নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে ইউএপিএ।