ভারতজুড়ে একসঙ্গে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণ কেন: কলকাতা হাইকোর্ট
১৬ জুলাই ২০২৫বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও ঋতমকুমার ডিভিশন বেঞ্চের প্রশ্ন হলো, ''হঠাৎ কেনো দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশি শনাক্ত করার কাজ শুরু হলো? এর পিছনে কী কারণ রয়েছে? সব রাজ্যের জন্য কেনই বা জুন মাস বেছে নেওয়া হলো?”
দুই বিচারপতির বেঞ্চের প্রশ্ন, "পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযানে যায়। একই সময়ে তল্লাশি শুরু হতে পারে। তার পেছনে একটি কারণ থাকে। এ ক্ষেত্রে কী কারণ রয়েছে? পূর্বপরিকল্পিত ভাবেই কি এটা করা হচ্ছে? অভিযোগ উঠছে, বাংলায় কথা বলার জন্য আটক করা হচ্ছে।”
বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী বলেন, ''কেন্দ্রীয় সরকারকে বিষয়টি জানানো হোক। কারণ, এর থেকে ভুল বার্তা যেতে পারে। ভুল পদক্ষেপ হতে পারে। বাংলায় কথা বলার জন্য আটক করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।”
কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবীর বক্তব্য
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অতিরিক্ত সলিসিটার জেনারেল ধীরাজ ত্রিবেদী জানিয়েছেন, ''পহেলগাম-কাণ্ডের পর কারো সন্দেহজনক গতিবিধি দেখলে ডেকে পাঠানো হয়। বাংলায় কথা বলার জন্য আটক করা হয় না। ১৬৫ জনকে আটক করা হয়েছিল। পাঁচজন স্বীকার করেছে, তারা বাংলাদেশি। তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।''
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় পদযাত্রা করার পর বলেছেন, ''আমার কাছে রিপোর্ট আছে, হাজারো মানুষকে আটক করা হয়েছে। কতজনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য আমি জোগাড় করছি। তবে প্রতিদিনই মানুষকে জেলে ভরা হচ্ছে।''
কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটার জেনারেল অশোককুমার চক্রবর্তী বলেন, ''এই বিষয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছে। সেই তথ্য গোপন করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছে।'' এরপর মামলাকারীদের আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করেন বিচারপতিরা।
রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ''মূল বিষয় হলো কীভাবে ঠিক করা হলো, কে ভারতীয় নাগরিক এবং কে নয়? কত জনকে আটক করা হয়েছে এবং কত জনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তথ্য দিয়ে সেটা জানাতে হবে কেন্দ্রকে।”
আদালতের নির্দেশ
দুই বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, পুরো বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে। ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের হলফনামা পাওয়ার পর বিচারপতিরা পরবর্তী নির্দেশ দেবেন। এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ৪ অগাস্ট।
রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বুধবার দুপুরেই বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের আটক করার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিল করেন। সঙ্গে ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিমসহ তৃণমূলের নেতারা।
পরে ডোরিনা ক্রসিংয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''বাঙালিদের এইভাবে হেনস্থা করা হলে মানব না। অবাঙালিদের বিরুদ্ধে অত্যাচার হবে না, বাঙালিদের বিরুদ্ধেও করতে দেব না। দিল্লি কী ভেবেছে। বাংলায় কথা বললে ওরা তাদের বাংলাদেশি বলবে, রোহিঙ্গা বলবে। বাংলাদেশিরা একটা আলাদা দেশের নাগরিক। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের কাছে সব কাগজ আছে, নথিপত্র আছে। তারপরও তাদের উপর অত্যাচার হচ্ছে।''
মমতা বলেন, ''পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা বাইরের রাজ্যে কাজ করে। কেই সোনার কাজ, কেউ নির্মাণশিল্পে কাজ করেন। তারা গরিব। বিজেপি গরিব-বিরোধী। শ্রমিকরা বাংলায় কথা বললে জেলে, ডিটেনশন ক্যাম্পে নিচ্ছে। কেন, কোন অধিকারে, বাংলা কি ভারতে নয়? আসাম সরকার কোন অধিকারে কোচবিহারের রাজবংশী মানুষকে নোটিশ পাঠায়?''
মমতা জানান, ''আমি নোটিফিকেশন দেখেছি, বলা হচ্ছে, বাংলাদেশি সন্দেহ হলে এক মাস আটক করে রেখে দিতে পার। এ তো মোর দ্যান এমার্জেন্সি। মিডিয়াকেও বাংলায় কথা বললে ডিটেনশন শিবিরে রেখে দেবে। আমি বেশি করে বাংলায় কথা বলব, পারলে আটক করে রেখে দিক। খেলা হবে। ইলেকশন কমিশনকে দিয়ে ভোটার বাদ দিয়ে বিজেপি এখানে জিততে পারবে না।''
কোন রাজ্যে হয়েছে?
বাংলায় কথা বলার জন্য আটকের অভিযোগ উঠেছে ওড়িশা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী জানাচ্ছেন, পাঁচজনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। তবে অভিযোগ, আরো অনেক বেশি মানুষকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করা হয়েছে।
বাংলাদেশি সন্দেহে ওড়িশায় সম্প্রতি ১৭জন শ্রমিককে আটক করা হয়। এর আগে ওড়িশার ঝাড়সুগুড়ায় দুইশজন শ্রমিককে আটক করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। গুজরাটের সুরাতে কাজ করতে যাওয়া বীরভূমের একজনকে পুলিশ আটক করে। পরিবারের সদস্যরা বোলপুর থানায় অভিয়োগ করেন। থানা থেকে যোগাযোগ করার পর তাকে ছেড়ে দেয় গুজরাট পুলিশ। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটার বাসিন্দা উত্তর কুমার ব্রজবাসীকে বাংলাদেশি ‘অভিযোগ' করে আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ডাকা হয়। সেই মামলা এখনো চলছে।
এছাড়া রাজস্থানে বাংলায় কথা বলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া অনেক শ্রমিককে আটকে রাখা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব রাজস্থানের মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের ছাড়া হয়।
মুর্শিদাবাদের মিনারুল শেখকে দিল্লিতে আটক করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার চেষ্টা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। মিনারুল ও আরো দুই ভারতীয়কে কোচবিহারের পুলিশ ফিরিয়ে আনে। পুলিশ দাবি করেছে, তিন যুবক বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি তাদের ধরে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুম'-এর সম্পাদক কিরীটি রায় এর আগে ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া ঢুকে থাকলে পুলিশ তাদের চিহ্নিত করবে, তবে (তা করতে হবে) আদালতের মাধ্যমে। তার জন্য ফরেনার্স আইনের ১৪ অনুচ্ছেদ আছে, পাসপোর্ট আইন আছে। সে সব কিছু না করে মূলত বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ধরা হচ্ছে, যারা বাংলাভাষী এবং যারা মুসলমান। তাদেরকে ধরে দেশের সংবিধান ও আইন-কানুন না মেনে সোজাসুজি বিএসএফের হাতে তুলে দিচ্ছে ও কাঁটাতারের বাইরে বিদেশের মাটিতে ফেলে দিচ্ছে।''
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা বলেছেন, ''একের পর এক রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষকে আটক করার অভিযোগ উঠেছে। এরপর যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টিকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, এটা বিজেপি-র বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি সেই রাজ্যের মানুষের অস্মিতার কথা বলে। এখানে মমতাও সেই প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণ নিয়ে বিজেপি যে রাজনৈতিক লাভ পাবে ভেবেছিল, তা তারা পাবে, নাকি উল্টো ফল হবে, তা দেখার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিষয়টি ঝড় তুলতে পারে।''
জিএইচ/এসসি