বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা এককভাবে নৈতিক সংকট নয়। এটি রাষ্ট্রের কাঠামোগত অক্ষমতা ও নারীবিরোধী শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিফলন।। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএ-র ২০২৫ সালের বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনো ১৮ বছরের আগেই প্রায় ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়, এবং ১৫–১৯ বছর বয়সি প্রতি এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন অন্তত এক সন্তানের জননী। একইসঙ্গে, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১১৫ জন, অর্থাৎ, প্রতি ৮৭০টি সন্তানের জন্মের জন্য একজন মা প্রাণ হারান।
এই চিত্র শুধুই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে প্রতিফলিত করে না, বরং নারী-শরীরকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের অন্তর্গত রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর উদ্ঘাটন ঘটায়। রাষ্ট্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পারিবারিক ব্যবস্থা এবং শিক্ষা কাঠামো, এই চারটি প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ সম্মিলিতভাবে একটি জেন্ডার্ড ডিসিপ্লিনারি কাঠামো নির্মাণ করে, যার ভেতর নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্তগ্রহণ ও শরীর, সমস্তই যৌথভাবে নিয়ন্ত্রিত, শাসিত এবং প্রান্তিকীকৃত হয়।
বাল্যবিবাহ: ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, কাঠামোগত সহিংসতা
বাল্যবিবাহকে অনেকেই ‘পারিবারিক ভুল' বা ‘গ্রামীণ কুসংস্কার' হিসেবে দেখেন। কিন্তু সমালোচনামূলক সমাজতত্ত্বের আলোকে, এটিকে আমরা দেখি একটি ‘স্ট্রাকচারর্যাল ভায়োলেন্স' হিসেবে, যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত কাঠামোর ভেতরেই মেয়েদের জীবনকে অনিরাপদ করে তোলা হয়। পল ফার্মার-এর ভাষায়, "স্ট্রাকচার্যাল ভায়োলেন্স ইজ সাইলেন্ট, ইনভিজিবল অ্যান্ড নরমালাইজড৷” বাংলাদেশে ১১–১৫ বছর বয়সি মেয়েদের স্কুল থেকে সরিয়ে এনে বিয়ে দেওয়া হয়, তাদের মতামতকে ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক' বলে উপেক্ষা করা হয়, অথচ ঠিক সেই বয়সেই তাদের গর্ভধারণ করতে বাধ্য করা হয়। এ এক জৈবিক ও সামাজিক বৈপরীত্যের চূড়ান্ত উদাহরণ।
রাষ্ট্রীয় দ্বিচারিতা ও আইনের ভেতরে বৈধতা খোঁজার আয়োজন
২০১৭ সালে প্রণীত ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন'-এ যুক্ত ‘বিশেষ পরিস্থিতি'র ধারা, যা আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ের বিয়েকে বৈধতা দিতে সক্ষম, আসলে একটি ‘আইনসিদ্ধ বৈধ ব্যতিক্রম' নয়, বরং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাজাত ক্ষমতা কাঠামোর একটি অন্তর্নিহিত দ্বিচারিতার প্রকাশ। এটি এমন এক ‘ব্যতিক্রমের নিয়ম', যা আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যকেই অবলীলায় বাতিল করে। ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই ধারার অপব্যবহারে ৬০,০০০-এরও বেশি বাল্যবিবাহ আইনি বৈধতা পেয়েছে।
এই বাস্তবতা বিশ্লেষণে মাইকেল ফোকল্টের ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার' ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র এখানে আইন ও নৈতিকতার ভাষা ব্যবহার করে, কিন্তু মূলত নারী-শরীর ও যৌনতাকে নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের একটি বায়োপলিটিক্যাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কিশোরীর যৌনতা, প্রেম বা সম্পর্ককে ‘বিচ্যুতি' হিসেবে চিহ্নিত করে, এবং বিয়ে নামক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে তাকে শৃঙ্খলিত করে। রাষ্ট্র ও সমাজ একত্রে এখানে ‘নিয়মতান্ত্রিক শুদ্ধতা' রক্ষার নামে নারী শরীরের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
ক্যারল পেইটম্যানের ‘দ্য সেক্সুয়েল কন্ট্রাক্ট' তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ধরনের আইন আসলে সামাজিক চুক্তির অন্তর্গত লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতার অসম চিত্র। সেখানে নাগরিকত্ব ও অধিকার পুরুষত্বের মানদণ্ডে নির্ধারিত হয় এবং নারীর সম্মতি ও ব্যক্তিসত্তা পরোক্ষভাবে পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের অধীন করে রাখা হয়। এই আইনি ধারাটি এই তত্ত্বকে কার্যত প্রতিফলিত করে: মেয়েদের কণ্ঠ, পছন্দ বা সম্মতি, সবই আদালতের (বা অভিভাবকের) অনুমোদনসাপেক্ষে বৈধতা পায়, তাদের নিজস্ব বিকাশ বা ইচ্ছা নয়।
অতএব, ‘বিশেষ পরিস্থিতি'র ধারা কেবল একটি আইনি ফাঁক নয়, এটি আধুনিক রাষ্ট্রীয় পিতৃতন্ত্রের একটি কৌশলগত যন্ত্র, যার মাধ্যমে নারী-যৌনতা ও নারীত্বকে ‘নিয়ন্ত্রণযোগ্য সামাজিক ঝুঁকি' হিসেবে পুনর্গঠিত করে বিয়ের কাঠামোর মধ্যেই তার নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা হয়, যেন রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এই নিয়ন্ত্রণই হয় একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান।
মাতৃমৃত্যু ও কিশোরী মায়ের ঝুঁকি: জীবনের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পিতৃতন্ত্রের জৈব-রাজনীতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্লোবাল সাউথ তথা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১৫ বছরের কম বয়সি মায়েদের মাতৃমৃত্যুর হার ২০ বছরের ঊর্ধ্ব নারীদের তুলনায় চারগুণ বেশি। ইউনিসেফ-এর ২০২১ সালের তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন গড়ে ২৬ জন কিশোরী গর্ভাবস্থা ও প্রসবজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে, এবং তাদের একটি বড় অংশ বাল্যবিবাহের শিকার। এ মৃত্যুগুলো কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি মৃত্যুই একটি রাষ্ট্রীয় নীতির নীরব ব্যর্থতা এবং কাঠামোগত সহিংসতার দলিল।
মিচেল ফোকল্টের বায়োপলিটিক্স তত্ত্বের আলোকে, এই পরিস্থিতি কেবল স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং নারীর শরীর, প্রজনন ও যৌনতার ওপর রাষ্ট্রীয় শাসনের একটি উদাহরণ, যেখানে শরীরকে ‘উৎপাদনযোগ্য' ও ‘ব্যবস্থাপনাযোগ্য' জনসংখ্যা ইউনিট হিসেবে ভাবা হয়। নারীর জীবন এখানে আত্মনিয়ন্ত্রিত বা অধিকারভিত্তিক নয়; বরং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরে তাকে নীতিনির্ধারক কাঠামোর আওতায় স্থিতিশীল ও নীরব থাকতে বাধ্য করা হয়।
জুডিথ বাটলারের ‘প্রিক্যারিয়াস লাইফ' ধারণা থেকে বলতে গেলে, এই কিশোরী মেয়েরা এমন এক ধরনের জেন্ডার্ড প্রিক্যারিটি-র শিকার, যেখানে তাদের জীবনকে সামাজিকভাবে মূল্যহীন ও ন্যায্য মৃত্যুরূপে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়। বাল্যবিবাহের ফলে তাদের শরীর রাষ্ট্র ও পরিবারের যৌথ সিদ্ধান্তের বস্তু হয়ে ওঠে, যেখানে মেয়ের সম্মতি, সক্ষমতা বা জীবনমান কোনোটাই প্রাধান্য পায় না। বরং বিয়ে ও মাতৃত্ব যেন হয়ে ওঠে তাদের ‘সামাজিক আত্মরক্ষা'-র একমাত্র পথ।
ল্যান্সেট গ্লোবাল হেল্থ- এ প্রকাশিত ২০২০ সালের একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৫–১৯ বছর বয়সি মায়েদের সন্তানদের মধ্যে অপুষ্টি, জন্মগত জটিলতা ও মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, যার ফলে একটি ‘ইন্টারজেনারেশনাল সাইকেল অব ডিজঅ্যাডভান্টেজ' গড়ে ওঠে, অর্থাৎ, এক প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও অধিকারহীনতা পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
এই চক্রকে ভাঙতে রাষ্ট্রকে শুধু স্বাস্থ্যখাতের টেকনিক্যাল সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; প্রয়োজন পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর সমালোচনামূলক ভাঙন, যেখানে নারী শরীর কেবল ‘প্রজননের' যন্ত্র নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ অধিকারসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত হয়।
ধর্ম, সংস্কৃতি ও নির্বাচনী গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে নারীর শরীর-রাজনীতি: নির্বাচিত আধুনিকতা ও জ্ঞানের ঔপনিবেশিকীকরণ
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের বিরোধিতা প্রায়শই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে "পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন” বলে আখ্যায়িত হয়। এই বয়ান একদিকে নারীর অধিকারবিষয়ক যেকোনো সংস্কারপ্রচেষ্টাকে ‘অসামাজিক' কিংবা ‘ইসলামবিরোধী' বলেই প্রত্যাখ্যান করে, অন্যদিকে নীরবে একধরনের পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি রক্ষা প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এই বিরোধিতা এক ধরনের প্যারাডিক্সক্যাল মডার্নিটি তুলে ধরে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ, ডিজিটাল প্রযুক্তি, এমনকি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞান পর্যন্ত পাশ্চাত্যের, কিন্তু নারীর অধিকার নিয়ে কথা উঠলেই ‘সংস্কৃতি রক্ষার' নামে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
এই ‘নির্বাচিত আধুনিকতা' আদতে একটি সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ভঙ্গি, যার অন্তর্নিহিত কাঠামো বিশ্লেষণ করতে গায়ত্রী চক্রবর্তী সিভাকের ‘এপিস্টেমিক ভায়োলেন্স' ধারণা কার্যকর। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জ্ঞান উৎপাদন, সাংস্কৃতিক বৈধতা এবং কণ্ঠস্বর নির্ধারণের ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে যে শ্রেণি বা গোষ্ঠীর হাতে থাকে, তারা অন্যদের অভিজ্ঞতা, ইতিহাস এবং আত্মপরিচয় প্রকাশের অধিকারকে দমন করে। বাংলাদেশি প্রেক্ষিতে এই গোষ্ঠী হলো, ধর্মীয় অভিভাবকগোষ্ঠী ও ভোটনির্ভর রাজনীতির সুবিধাভোগী শ্রেণি, যারা নারীর পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে, এবং নারীর প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে ‘নৈতিকতা' বা ‘পারিবারিক শৃঙ্খলা' বলে বৈধতা দেয়।
এইভাবে নারীর শরীর ও সিদ্ধান্ত ক্ষমতা হয়ে ওঠে একটি সিম্বলিক ব্যাটলফিল্ড, যেখানে আধুনিকতা গ্রহণ করা হয় তখনই, যখন তা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু নারীর স্বাধীনতা বা আত্মনির্ধারণের মতো বিষয়গুলো এলেই শুরু হয় ঐতিহ্য রক্ষার নাম করে অবমানবিকীকরণের ভাষা। এই ভণ্ডামি নারীর অধিকার প্রশ্নে রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত মোল্লাতন্ত্র ও পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাকারী এক দ্বৈতচরিত্রে পরিণত করেছে।
প্রতিরোধমূলক উদ্যোগের কাঠামোগত ব্যর্থতা: সামাজিক পরিবর্তনের পথে অন্তরায় কোথায়?
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নেওয়া নানা কর্মসূচি ও সচেতনতামূলক উদ্যোগ প্রায়শই কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতার কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই ব্যর্থতা কেবল ‘নৈতিক শিক্ষার অভাব' দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং এটি এক ধরনের iইন্সটিটিউশনাল ইলোশন অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি, যেখানে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নারী-স্বার্থরক্ষার বদলে বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোকে টিকিয়ে রাখে।
১. নৈতিকতার সংকট নয়, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির সংকট
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যতই সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা হোক না কেন, বাস্তবে যখন স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাল্যবিবাহে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে, তখন রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা নিছক একটি রিচুয়েলাইজড পারফর্ম্যান্স হয়ে পড়ে। ফাউকল্ডিয়ান বিশ্লেষণে একে ‘ডিসিপ্লিনারি পারফর্ম্যান্স উইদাউট স্ট্রাকচারাল পাওয়ার ডিসরাপশন' বলা যায়, যেখানে শৃঙ্খলা প্রদর্শিত হয়, কিন্তু ক্ষমতার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকে।
২. যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার অনুপস্থিতি: জ্ঞানহীনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ
কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রায়শই ‘অশ্লীলতা' বা ‘সংস্কৃতি বিরোধী' বলে অস্বীকৃত হয়। অথচ এই মেয়েরাই সবচেয়ে জটিল জৈবিক ও মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়, অজ্ঞানতা, ভয়,
নিপীড়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক নীরবতার মধ্যে। জুডিথ বাটলারের ভাষায়, এ এক ধরনের ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড প্রিক্যারিটি', যেখানে জ্ঞানের অভাবটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়, যেন মেয়েদের ওপর নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
৩. স্ট্রাকচারাল সমস্যায় সিম্পটোম্যাটিক প্রতিক্রিয়া
বাল্যবিবাহের গভীরতর কারণ যেমন, দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীননারী, লিঙ্গভিত্তিক সম্মানসংক্রান্ত সংস্কার সবই কাঠামোগত। অথচ রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াগুলো প্রায়শই সিম্পটোম্যাটিক এবং টোকেনিস্টিক: উপবৃত্তি, বিজ্ঞাপন, ওয়ান-ডে কনফারেন্স। ন্যন্সি- ফ্যাজারের ভাষায়, এটি ‘রিকগনিশন উইদাউট রিডিস্ট্রিবিউশন', প্রতীকী সমাধান দিয়ে বাস্তব সমস্যাকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা।
৪. নিয়ন্ত্রণের ছদ্মবেশে নিরাপত্তা
কিশোরীর প্রেম বা ভালোবাসার অনুভূতি অনেক পরিবার ‘সমাজচ্যুতি'র ঝুঁকি হিসেবে দেখে। ফলে নিরাপত্তার নামে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেয়, যেখানে ‘প্রেম' অপরাধী আর জোরপূর্বক বিয়ে বৈধ সামাজিক আচরণ। অথচ বাংলাদেশ সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে, এবং জোরপূর্বক বিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সহিংসতা।
সংস্কার যদি হয় সত্যিকার, রাষ্ট্রকে নিতে হবে রাজনৈতিক ঝুঁকি
বাল্যবিবাহের প্রশ্ন শুধু একটি উন্নয়ন সমস্যা নয়, এটি নারীর নাগরিকত্ব, শরীর এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার প্রশ্ন। একটি সমাজে নারীর মর্যাদা কোথায় সেটিই বাল্যবিবাহের প্রকৃত পরীক্ষাসংকেত। যদি রাষ্ট্র সত্যিই নারীর ওপর আস্থা রাখে, তাহলে:
· ‘বিশেষ পরিস্থিতি'র ধারা বাতিল করতে হবে, যা কার্যত একটি বৈধীকৃত ব্যতিক্রমের মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
· যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে নারীর শরীর সম্পর্কে তার নিজস্ব জ্ঞান ও সিদ্ধান্ত সক্ষমতা তৈরি হয়।
· স্থানীয় প্রশাসনকে আইনি ও নৈতিকভাবে জবাবদিহির কাঠামোয় আনতে হবে, যাতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পিতৃতন্ত্রের সুবিধাবাদ চলে না।
· ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আপস নয়, নারীর মানবিক মর্যাদা ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এটি কোনও পশ্চিমা চাপ নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব।
এই সেই সমাজ, যেখানে ১১ বছর বয়সে প্রেম করলেই মেয়েকে ‘খারাপ' বলে দাগানো হয়, কিন্তু বিয়ে দিলে বলা হয় সে ‘সমাজরক্ষা'র পথে এসেছে। এই দ্বিচারিতা আইন দিয়ে ভাঙা যাবে না, এর জন্য প্রয়োজন একটি নৈতিক বিপ্লব, যার নেতৃত্ব দিতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ ও নারীর নিজস্ব কণ্ঠস্বরকে।