বাগেরহাটের মসজিদে, শ্মশানে সম্প্রীতির ছোঁয়া
২৯ এপ্রিল ২০২২তবে কিছু লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন যে, তারা দখল করা জমি দান করে নিজেদের মহিমান্বিত করছেন৷ কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে এবং প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লোকের দখলি জমির ‘গল্প’ অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়৷ প্রকৃতপক্ষে বৈধ মালিকানার জমিই দিয়েছেন দুজন৷ এবং জমি দিয়ে তারা প্রচারও চাননি৷ চাইলে জমি যখন দিয়েছেন তখনই তা প্রচার করতে পারতেন৷
গত ২৩ এপ্রিল হাঙ্গার প্রজেক্ট ধর্মীয় সম্প্রীতির কাজ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দুই অনন্য নজিরের কথা সামনে নিয়ে আসে৷
ফকিরহাট বিশ্ব রোডের পাশে মসজিদের জন্য জমি দিয়েছেন ফকিরহাট আজাহার আলী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ৷ আর ভৈরব নদের তীরে শ্মশানের জন্য জমি দিয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মিজানুর রহমান৷
মসজিদ ও শ্মশানে জমি দেয়ার পটভূমি
অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ উত্তরাধিকার সূত্রেই অনেক জমিজমার মালিক৷ ফকিরহাট ডিগ্রি কলেজসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দানের জমিতেই গড়ে উঠেছে৷ সেখানকার রেললাইনও তাদের জমির ওপর দিয়ে গেছে৷
খুলনা-মাওয়া মহাসড়ক চালু হলে ফকিরহাট সদর ইউনিয়নের আট্টাকি গ্রামের মোড়টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসা কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ স্থানীয়ভাবে এর নাম হয় বিশ্বরোডের মোড়৷ ওই মোড়ে প্রণব কুমার ঘোষের অনেক জমি৷ তিনি সড়কের পাশে বড় একটি মার্কেট করেন৷ কিন্তু সেখানে কোনো মসজিদ ছিল না৷ আশপাশে মুসলমানদের মধ্যে কারোই মসজিদ করার মতো জমি নেই৷ এ কারণে ওই এলাকার লোকজন মসজিদের জন্য জমি চাইলে প্রণব কুমার ঘোষ ৪০ শতক জমি দিয়ে দেন৷ সেখানে এখন দোতলা মসজিদ হয়েছে৷ সামনে আরো কিছু জায়গা নিয়ে ঈদগাঁ হয়েছে৷ এটা ২০০৯ সালের ঘটনা৷
প্রণব কুমার ঘোষ জানান, ‘‘আমাদের এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক ভালো৷ দীর্ঘদিন ধরে আমরা এক সঙ্গে বসবাস করি৷ সবাই আমাকে অনেক সম্মান করে৷ মুসলমানদের মসজিদ তো দরকার৷ আমার টাকা নেই, জমি আছে৷ তাই জমি দিয়েছি৷ মসজিদ তারাই বানিয়েছে৷ ঈদগাঁর জন্য জমি দিয়েছি নাম মাত্র দামে৷’’
জমির বৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আমার দাদু ইন্দু ভূষণ ঘোষ ছিলেন জমিদারের ম্যানেজার৷ এই এলাকায় আমাদের অনেক ভূসম্পত্তি আছে৷ অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা জমি দিয়েছি৷ রেলকেও আমরা জমি দিয়েছি৷ কেউ কেউ বলতে চান, এটা রেলের জমি৷ আসলে এটা ঠিক নয়৷ সেটা হলে তো মার্কেট করতে পারতাম না৷ আমার পৈত্রিক জমিই আমি মসজিদে দিয়েছি৷ তাদের কয়েকটা দোকানও করে দিয়েছি৷’’
এদিকে ফকিরহাটের ভৈরব নদের তীরেই ছিল ওই এলাকার হিন্দুদের কেন্দ্রীয় শ্মশান৷ নদী খননের কারণে শ্মশানটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়৷ মিজানুর রহমান শেখ বলেন, ‘‘তারপরও হিন্দুরা নদীর তীরে আমার জমিতে মৃতদেহ সৎকার করতো৷ তারা আমার কাছেও আসে৷ এরপর আমি তাদের শ্মশানের জায়গা দিই৷ তারা কাজ শুরু করেছেন৷ আমার অনেক জমি আছে, তাদের যতটুকু লাগে তারা পাবেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এলকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক দৃঢ়৷ আমরা দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছি৷ আর আমি নিজেও জনপ্রতিনিধি৷ দুইবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম৷ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত৷ আমার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান৷ আমরা এখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকি৷’’
জমির বৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এটা বিআইডাব্লিউটিএ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে লীজ নেয়া জমি৷ এটার মূল মালিক অরবিন্দ পাল মনি৷ তাদের জমি বিআইডাব্লিউটিএ অধিগ্রহণের পর যা তাদের লাগেনি, তা ফেরত দিয়েছে৷ তারপর আমি তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি৷ জমির লাইসেন্স আমার নামেই৷’’
প্রশাসনের জবাব
ফকিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপন কুমার দাস বলেন, ‘‘তারা দুইজন যে মাহনুভবতা দেখিয়েছেন তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ এটা এই এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সব ধর্মের সহ-অবস্থানকে আরো দৃঢ় করবে৷’’
আর জমি নিয়ে যে বিতর্ক তোলা হয়েছে তার জবাবে তিনি বলেন, ‘‘শেখ মিজানুর রহমান যে জমি শ্মশানে দিয়েছেন তা বিআইডাব্লিউটিএ থেকে লিজ নেয়া৷ তার একটি অংশ শ্মশানে দিয়েছেন৷ এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই৷ আর প্রণব কুমার ঘোষ যে জমি মসজিদে দিয়েছেন সেটা তো তার পৈত্রিক সম্পত্তি৷ এটা সবাই জানে৷’’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা বেগম বলেন, ‘‘আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই দুই ব্যক্তির এই প্রশংসনীয় কাজের কথা জেনেছি৷ যেখানে আমরা এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্কে ভুগছি, সেই সময়ে এই কাজ অবশ্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখবে৷’’
যেভাবে সবাই জানলো...
হাঙ্গার প্রজেক্টের ফকিরহাটের সমন্বয়কারী খান মাহমুদ আরিফুল হক জানান, তারা এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করেন৷ প্রণব কুমার ঘোষ জমি দেন ২০০৯ সালে আর শেখ মিজানুর রহমান দেন এক বছর আগে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করলাম এটা সবার জানা উচিত৷ সবাই জানলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মানুষ আরো উদ্বুদ্ধ হবে৷ তাই ২৩ এপ্রিল আমরা একটি অনুষ্ঠান করে ওই দুইজনকে সম্মাননা দিই৷ তখন এটা সবাই জানে, সংবাদ মাধ্যমেও খবর হয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘দুটি পরিবারই এই এলাকার দাতা পরিবার৷ আমি দুই পরিবারকেই অনেক দিন ধরে জানি৷ এই এলাকায় তাদের আরো অনেক দান আছে৷ এলাকার মানুষও এটা জানে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ জমির বৈধতা নিয়ে কথা বলছেন৷ তারা না জেনে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছেন৷ তারা তাদের বৈধ জমিই দান করেছেন৷’’