বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর বেড়ে চলা হামলায় আরএসএফ-এর উদ্বেগ
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এক প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠনটি বলেছে, আশা করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পরিস্থিতির উন্নতি হবে, কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর হামলা নিয়মিতই হচ্ছে৷
বাংলাদেশের সাংবাদিক নেতারাও আরএসএফ-এর এই প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত হয়ে সরকারকে সাংবাদিকদের সুরক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
আরএসএফ বলেছে, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র হচ্ছে। সাংবাদিকদের এখন হাতুড়িপেটা ও লাঠিপেটা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষেও হামলা চালানো হচ্ছে। পুলিশ ও রাজনৈতিক কর্মীরা এই হামলা চালাচ্ছে। আরএসএফ এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দেয়ার দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে।
ফেব্রæয়ারি মাসে বাংলাদেশে কিছু সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে আরএসএফ৷ গত ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এর কার্যালয়ে কয়েক'শ ব্যক্তির হামলার চেষ্টার কথাও উল্লেখ করা হয় সেখানে। সেই ঘটনা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমটির সম্পাদক হোসাইন তওফিক ইফতেখার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় ওই দিন দুপুরে বিআরটিসির বাসে করে এসে করেকশ' লোক আমাদের প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা করে। তারা নিউজরুমে ঢোকার চেষ্টা করে। গুজব ছড়িয়ে হামলা চালাতে চেয়েছিল তারা। এক ধরনের তথাকথিত মব জাস্টিস করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে হামলা চালাতে পারেনি।”
শরীয়তপুরের একটি ক্লিনিক নিয়ে প্রতিবেদন করায় গত ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল-এর স্থানীয় প্রতিনিধি সোহাগ খানকে হাতুড়িপেটা ও ছুরিকাঘাতে গুরুতরভাবে আহত করা হয়। হামলার আগে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছিল তাকে। তাকে রক্ষা করতে গেলে নিউজ ২৪ টিভির বিধান মজুমদার অনি, বাংলা টিভির নয়ন দাশ এবং দেশ টিভির সাইফুল ইসলাম আকাশের ওপরও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেও সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়৷ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের জাভেদ আখতারের ওপর কতিপয় বিএনপি সমর্থকের ওই হামলা সম্পর্কে আরএসএফ বলেছে, তাকে (জাভেদ আখতার) সহযোগিতা করতে এলে আরো দুই সাংবাদিক এনটিভির হাসান জাভেদ এবং দীপ্ত টিভির আজিজুল ইসলাম পান্নুও হামলার শিকার হন।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নাম্বারের বাড়ি ভাঙচুরের সময় কয়েকজন সাংবাদিকের ওপর হামলার কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে আরএসএফ। সেখানে হামলার শিকার হন ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির মোহাম্মদ ওমর ফারুক এবং ৭১ টিভির সৈয়দ মাইনুল আহসান মারুফ। মাইনুল আহসান মারুফ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি রাত দুইটার দিকে আমার টেলিভিশনে লাইভ দিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে ‘দালাল, দালাল' বলে আমার ওপর হামলা চালানো হয়। আমার ক্যামেরা পার্সনও হামলার শিকার হন। অনেক উত্তেজিত মব ছিল সেখানে। এক পর্যায়ে ক্যামেরা ও বুম লুকিয়ে আমরা রক্ষা পাই।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "সেখানে কোনো পুলিশই তো ছিল না। আমাদের রক্ষা করকে কে?'' কারো বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কিনা জানতে চাইলে সাংবাদিক মারুফ আহসান জানতে চান, ‘‘মামলা কার বিরুদ্ধে করবো?”
সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার উদাহরণ হিসেবে ৯ ফেব্রুয়ারি ছয় সাংবাদিকের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনাটি উল্লেখ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স। বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকায় ছাত্রদের একটি বিক্ষোভের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পুলিশ ওই ছয় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। দাঙ্গা পুলিশের সদস্যরা তাদের লাথি মারেন এবং লাঠিপেটা করেন। এ ঘটনায় আহত সাংবাদিকেরা বলেছেন, পরিচয়পত্র দেখানোর পরও তাদের ওপর হামলা হয়। হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন রিপোর্ট লাইভ টিভির কাওসার আহমেদ রিপন, কালের কন্ঠের আসিফ উজ জামান ও মোহাম্মদ মেহেদী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের আজহার রাকিব, জাগো নিউজের মোহাম্মদ রেদওয়ান এবং ব্রেকিং নিউজের শিমুল খান।
বিবৃতিতে আরএসএফ-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডেস্কের প্রধান সিলিয়া মার্শিয়ে বলেন, ‘‘বিগত কয়েক দিনে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক গুরুতর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা দেশটিতে উদ্বেগজনকভাবে গণমাধ্যমের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর উন্নতির আশা করা হলেও সাংবাদিকেরা অরক্ষিত রয়ে গেছেন।''
সিলিয়া মার্শিয়ে আরো বলেন, ‘‘দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তাদের (সাংবাদিকদের) আক্রমণ করা হচ্ছে। প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে প্রতিশোধমূলক শারীরিক হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এছাড়া বিক্ষোভকারীরা বার্তাকক্ষে আক্রমণ করছে। এসব হামলার জন্য দায়ী সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করা এবং এ ধরনের সহিংসতা বন্ধ ও গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে আরএসএফ।''
আরএসএফ-এর বিবৃতি ও আহ্বান সম্পর্কে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, " আরএসএফ যে প্রতিবেদন দিয়েছে, যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে, তা ঠিকই আছে। আমরাও আশা করেছিলাম, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় হওয়ার পর এই সরকারের সময় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না।''
তিনি বলেন, "আমরা সাংবাদিকদের ওপর এইসব হামলায় বিস্মিত। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ছে। এখনো যদি হামলা নির্যাতন হয়, তাহলে আগের ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে পার্থক্য কী? সরকারের উচিত হবে সাংবাদিকদের ওপর হামলায় যারা জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে আর যাতে এরকম ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা নেয়া।”
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, "এটা দূঃখজনক। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও সাংবাদিকদের ওপর হামলা হচ্ছে। গত সাড়ে ১৫ বছর স্বৈরাচারী শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সাংবাদিকদের হত্যা, নির্যাতন করা হয়েছে, এখন তো সেই পরিবেশ থাকার কথা নয়। কিন্তু এখনো আছে। সরকারকে অতি দ্রুত এটা কমাতে হবে। হয়তো সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের অনেক কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নাই। এটা দৃশ্যমান।”
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, "সংবাদমাধ্যমের জন্য এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এটা সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে যে মব জাস্টিস হচ্ছে, তাতে সমাজে ভয় ছড়িয়ে পড়ছে।”
"আগে জামায়াত-শিবির বলে হামলা করা হতো, এখন ফ্যাসিবাদের দোসর বলে একই ধরনের কাজ করা হচ্ছে। আগে সরাসরি ফ্যাসিবাদী সরকারের আক্রমণের শিকার হতেন সাংবাদিকরা, এখন ভিন্ন কৌশলে করা হয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, যেমনটি ফ্যাসিজমের সময় আমরা দেখেছি,” বলেন তিনি। তার কথা, "পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, কিছু মানুষ গুণগান করবে, কিছু মানুষ কথা তুলবে, জিহ্বায়-ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কথা বলবে যে কথা অস্পষ্ট থাকবে।”