বরুণের ঘূর্ণিতে ভারতের বিজয়
২ মার্চ ২০২৫টসে হারলেন রোহিত শর্মা৷ বলা চলে টসে হারাটা অভ্যাসই হয়ে গেছে ভারত অধিনায়কের। ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে, আহমেদাবাদে টস হারার পর থেকে কেবল হেরেই চলেছেন মূদ্রানিক্ষেপের পরীক্ষায়৷ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা দিয়ে টানা ১০ ম্যাচে টসে হারলেন রোহিত৷ নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার অবধারিত ভাবেই নিয়েছেন বোলিং, দুবাইর এই স্টেডিয়ামে পরে ব্যাট করা দলেরই যে জয়ের সম্ভাবনা বেশি। যদিও দিন শেষে সেই জয়ের দেখা আর পায়নি ব্ল্যাকক্যাপরা৷
ভারত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সবগুলো ম্যাচই খেলছে দুবাইতে। তৃতীয় ম্যাচে এসে রোহিত একাদশে সুযোগ দিলেন রহস্য বোলার বরুণ চক্রবর্তীকে, বসালেন পেসার হর্ষিত রানাকে। ভারত অধিনায়কের এই জুয়াটাই কাজে লেগে গেল দারুণভাবে। ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে নামা বরুণ নিলেন ৪২ রানে ৫ উইকেট, তাতেই নিউজিল্যান্ড কুপোকাত৷
ব্যাটিংয়ের শুরুটা ভাল হয়নি ভারতের। ম্যাচের তৃতীয় ওভারেই ম্যাট হেনরি লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলে বিদায় করেন ছন্দে থাকা শুভমান গিলকে (২)। ষষ্ঠ ওভারে কাইল জেমিসনের বলে পুল করতে গিয়ে স্কয়ার লেগে উইল ইয়ং এর হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন রোহিত শর্মা (১৫)। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচজেতানো সেঞ্চুরি করা বিরাট কোহলিকেও অল্পতেই থামিয়ে দিয়েছে ব্ল্যাকক্যাপরা। ম্যাট হেনরির শর্ট, অফ স্টাম্পের বাইরে করা বলে সজোরে ব্যাট চালিয়েছিলেন কোহলি, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ লুফে নিয়ে ১১ রানেই কোহলিকে বিদায় করে দিয়েছেন গ্লেন ফিলিপস। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই দারুণ ক্যাচ ধরেন ফিলিপস, তবে এই ক্যাচটা হয়ত এই আসরের সেরা ক্যাচেরই মর্যাদা পাবে। কোহলির ব্যাট থেকে তার হাতে বল যেতে মাত্র দশমিক ছয়-দুই সেকেন্ড সময় লেগেছে, বলা যায় চোখের পলকেই বাজপাখির মত ঝাঁপিয়ে ক্যাচটা নিয়েছেন ফিলিপস।
৩০ রানেই তিন উইকেটের পতনের পর চতুর্থ উইকেটে শ্রেয়াশ আইয়ার এবং অক্ষর প্যাটেল মিলে ধ্বস ঠেকান। এই দুইজনের ১৩৬ বলে ৯৮ রানের জুটিতেই নড়বড়ে ভাবটা কাটিয়ে সম্মানজনক একটা সংগ্রহের পথে এগিয়ে যায় ভারত৷ দলীয় ১২৮ আর ব্যক্তিগত ৪২ রানে আউট হয়ে যান অক্ষর প্যাটেল, রাচিন রবীন্দ্র'র বলে কেন উইলিয়ামসনের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে। তাতেই ভাঙ্গে জুটি, এরপর লোকেশ রাহুল এসে শ্রেয়াশের সঙ্গে জুটি বাঁধেন। দুইজন মিলে যোগ করেন আরও ৪৪ রান৷ রান তোলার গতিটা বাড়ে হার্দিক পান্ডিয়া উইকেটে আসলে, ৪৫ বলে ৪৫ রান করে এই অলরাউন্ডার বিদায় নেন শেষ ওভারে৷
ভারতের ইনিংসটা দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়াশ আইয়ারের ৭৯ রানের ইনিংসের উপর ভর করে। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭০ বলে ১০৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন শ্রেয়াশ। রোববারের ইনিংসটা অবশ্য একদমই উলটো বৈশিষ্ট্যের, পরিস্থিতির দাবী মিটিয়ে ৯৮ বলে ৭৯ রান করেছেন মাত্র চারটি বাউন্ডারি আর দুই ছক্কায়। দুইটি বড় জুটিতে একপ্রান্ত আগলে রেখে নিশ্চিত করেছেন পুরো ৫০ ওভার খেলাটা।
নয় উইকেটে ২৪৯ রানে শেষ হয় ভারতের ইনিংস। শেষ ওভারে দুই উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মতো ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ম্যাট হেনরি। আট ওভার বল করে ৪২ রানে পাঁচ উইকেট শিকার এই ডানহাতি ফাস্ট বোলারের। এক উইকেট করে নিয়েছেন উইল ও রুর্ক, মিচেল স্যান্টনার, রাচিন রবীন্দ্র ও কাইল জেমিসন। বাংলাদেশের বিপক্ষে চার উইকেট নেয়া মিচেল ব্রেসওয়েলই একমাত্র উইকেটশুন্য বোলার।
রানতাড়ায় নিউজিল্যান্ডও খুব একটা ভাল শুরুর দেখা পায়নি। নতুন বলে বল করছিলেন মোহাম্মদ শামি এবং হার্দিক পান্ডিয়া। রাচিন রবীন্দ্র চতুর্থ ওভারের শেষ বলে কাট করতে গিয়ে ডিপ থার্ড ম্যানে থাকা অক্ষর প্যাটেলের হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন মাত্র ছয় রান করে। ওয়ান ডাউনে নামা কেন উইলিয়ামসন ও উইল ইয়ং মিলে ৩২ রানের জুটি করে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দিলেও বরুণ চক্রবর্তীর সামনে ভেঙ্গে যায় সেই বাঁধ। উইল ইয়ংকে বোল্ড করে জুটি ভাঙ্গেন বরুণ, এরপর ড্যারিল মিচেলের সঙ্গে উইলিয়ামসনের জুটিটাও খানিকটা স্থায়ীত্ব পেলে কুলদীপ যাদবের হাতে ভাঙ্গে তাদের ৪৪ রানের জুটিও। একটা প্রান্ত আগলে রাখছিলেন কেন উইলিয়ামসন, অন্যপ্রান্তে দুইটি চল্লিশের ঘরের জুটির পর সঙ্গী বদল হয়৷ এরপর স্থায়ীত্ব কমে আসে, ২০ রানের কমে ভেঙ্গে যায় উইলিয়ামসন আর তার সঙ্গীদের সমঝোতা৷ কারণ একের পর এক স্পিনারদের আঁটসাঁট বোলিংয়ের ফাঁসে ছটফট করেই বিদায় নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘদেহী সব ব্যাটাররা। মিচেলকে বিদায় করেছেন কুলদীপ, টম ল্যাথাম আউট হয়েছেন রবীন্দ্র জাদেজার বলে লেগ বিফোর উইকেট হয়ে৷ বরুণ চক্রবর্তী ছেঁটেছেন লোয়ার মিডল অর্ডারটা, যেটা নিউজিল্যান্ড দলের অন্যতম শক্তির জায়গা। গ্লেন ফিলিপস, মিচেল ব্রেসওয়েল, মিচেল স্যান্টনার এবং ম্যান হেনরি; এই চার ব্যাটারকে একে একে আউট করেছেন বরুণ৷ তবে সবচেয়ে মূল্যবান উইকেটটা নিয়েছেন অক্ষর। তার বোলিং স্পেলের একদম শেষ বলে তুলে নিয়েছেন উইলিয়ামসনের উইকেট, তার বলে এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে স্টাম্পড হয়েছেন সাবেক কিউই অধিনায়ক। তার নামের পাশে তখন ৮১ রান।
উইলিয়ামসন এবং স্যান্টনার যখন ব্যাট করছিলেন, তখনও নিউজিল্যান্ডের জয়ের কিছুটা হলেও সম্ভাবনা ছিল। তাদের জুটিটা ভেঙ্গে যাবার পরই আসলে সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় নিউজিল্যান্ডের হার। কুলদীপ যাদবের বলে উইল ও'রুর্ক এর স্টাম্প ভাংতেই উল্লাসে ফেটে পড়েন গ্যালারিতে থাকা ভারতীয় সমর্থকরা। কারণ তাতেই যে নিশ্চিত হয়েছে ভারতের ৪৪ রানের জয়৷ ৪৫.৩ ওভারে নিউজিল্যান্ড অলআউট হয়েছে ২০৫ রানে।
শ্রেয়াশ আইয়ার হাফসেঞ্চুরি করেছেন, অক্ষর প্যাটেলও ব্যাটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন উইলিয়ামসনের উইকেট। তবে ভারতের ম্যাচ জয়ের নায়ক নিঃসন্দেহে বরুণ। টি-টোয়েন্টি দলে বেশ নিয়মিতই খেলেন, তবে ওয়ানডে দলে জায়গা পান না অনেকদিন ধরেই। ৯ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে নিতে প্রাথমিক দলে থাকা যশস্বী জয়সওয়ালকে বাদ দিয়ে তার নাম চূড়ান্ত দলে ঢুকিয়েছিল ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট। বরুণ সম্পর্কে রোহিত বলেছিলেন যে অনুশীলনে খেলার সময়ও তার বরুণের বল খেলতে সমস্যা হয়। সেই রহস্য স্পিনারই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হয়ে উঠেছেন রোহিতের তুরুপের তাস। ৪২ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে বরুণ ভারতকে শুধু ম্যাচটাই জেতাননি, হয়েছেন ম্যাচসেরাও।
ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে শেষ হলো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গ্রুপ পর্ব। আর শুধু ৩টা ম্যাচ বাকি, দুটো সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। মঙ্গলবার দুবাইতে মুখোমুখি হবে ভারত- অস্ট্রেলিয়া আর মঙ্গলবার নিউজিল্যান্ড খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ভারত ফাইনালে উঠলে ফাইনাল হবে দুবাইতে, অন্যথায় লাহোরে ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত ৫০ ওভারে ২৪৯/৯, নিউজিল্যান্ড ৪৫.৩ ওভারে ২০৫
ফল: ভারত ৪৪ রানে জয়ী
ম্যাচ সেরা: বরুণ চক্রবর্তী