ফের অপহরণের ঘটনা: ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র
৩০ মার্চ ২০২৫পেটের তাগিদে তামিলনাড়ুতে গিয়েছিলেন ১৬ জন শ্রমিক৷ এর মধ্যে মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম ও বহরমপুরের আট জন ছিলেন৷ বীরভূমের রামপুরহাটের থেকে গিয়েছিলেন বাকি আটজন৷ গত বুধবার তারা রওনা দেন তামিলনাড়ুর উদ্দেশে৷
সেখানে তাদের জন্য যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা ভাবতে পারেননি কেউই৷ তাদের পড়তে হয় অপহরণের ফাঁদে৷ বাড়িতে ফোন করে চাওয়া হয় মুক্তিপণ৷
যেভাবে অপহরণ
বৃহস্পতিবার তামিলনাড়ুতে পৌঁছেও বিপদের আঁচ পাননি তারা৷ যুবকরা দেখেন, একটি গাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷ তারা ভাবেন, যেখানে কাজের জন্য যেতে হবে, সেখান থেকে পাঠানো হয়েছে৷
কিছুক্ষণের মধ্যে ভুল ভাঙে৷ যুবকরা বুঝতে পারেন, তাদের অপহরণ করা হয়েছে৷ তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সালেমে৷ সেখান থেকে শ্রমিকদের পরিজনকে ফোন করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ চাওয়া হয়৷ অপহরণ ও মুক্তিপণের কথা পুলিশকে জানান পরিবারের সদস্যরা৷
নবগ্রাম, বহরমপুর ও রামপুরহাট থানা তামিলনাড়ু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ যে নম্বর থেকে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এসেছিল, তার টাওয়ার লোকেশন দেখায় সেই রাজ্যের সালেমে৷ তামিলনাড়ু পুলিশ অভিযান চালায় অপহরণকারীদের ডেরায়৷ সেখান থেকেই উদ্ধার করা হয় ১৬ জন শ্রমিককে৷
পুরো অপারেশন চালাতে ছয় ঘণ্টা লাগে৷ পাকড়াও করা হয়েছে দুষ্কৃতীদের৷ পরিযায়ী শ্রমিকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা তামিলনাড়ুতে কাজ না করে রাজ্যে ফিরে আসবেন৷
কাজের খোঁজে
কাজের খোঁজে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যান শ্রমিকেরা৷ ভারতে এমন শ্রমিকের সংখ্যা বিপুল৷ ২০২৩ সালে শ্রম মন্ত্রকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা চার কোটি ১৪ লক্ষ৷ এই সংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ৷ যদিও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ৷
এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নেই আইনি স্বীকৃতি, নেই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা৷ কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্র থেকে নিজ নিজ রাজ্যে ফেরার সময়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছিলেন৷
সম্প্রতি এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ওড়িশা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন৷ পশ্চিমবঙ্গ লিগ্যাল এইডস সার্ভিস আয়োজিত আলোচনা সভায় বিচারপতি ট্যান্ডন বলেন, "দেশের উন্নয়নে শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য, তাই তাদের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা নেওয়া জরুরি৷"
বিচারপতি ট্যান্ডনের পর্যবেক্ষণ, "সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি৷" তিনি বলেন, "শ্রমিকদের সুরক্ষায় সরকার ও সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব রয়েছে৷ তাই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আইন আরও শক্তিশালী করা এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রম আইন আরও কার্যকর করা উচিত৷"
দুর্দশার মধ্যে থাকা শ্রমিকদের অপহরণের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে৷ উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের ১৫ জন পরিযায়ী শ্রমিক কেরালায় কাজে গিয়ে এমনই বিপদে পড়েছিলেন৷ তাদের আটকে রাখা হয় তামিলনাড়ুর চিরুচংটু এলাকায়৷ একটি ঠান্ডা পানীয় সংস্থায় কাজে গিয়েছিলেন শ্রমিকেরা৷ মুক্তিপণ দাবি করা হয় শ্রমিকদের কাছে৷ না দিলে প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয়৷
সম্মানজনক সুরক্ষা বা মানবিক ব্যবস্থা নেই
ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকেরা কখনো বাংলাদেশি সন্দেহে সমস্যায় পড়েছেন, কখনো দুর্ঘটনায় বা অনাহারের মুখে পড়েছেন৷ এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে অপহরণ৷
সাবেক বাম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা যে কতটা গভীর সেটা কোভিড না হলে বোঝা যেত না৷ তারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রগুলি ক্রমশ বাড়ছে৷ এরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন, আইনগত অধিকার বা নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ কার্যকর করার জন্য উদ্যোগ তারা নিতে পারেন না৷ মানুষের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা অন্যের কৃপার উপর নির্ভর করছেন৷ তাই তাদের সংগঠিত না করলে কিছু করা যাবে না৷"
মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য যে ধারাবাহিক কাজ করা দরকার, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের সরকার তা করে না৷ একমাত্র কেরালা ছাড়া অন্য কোনো রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক সুরক্ষা বা মানবিক ব্যবস্থা নেই৷"
তিনি বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ রাজ্যগুলোর সরকারের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের মানবাধিকার বিপন্ন৷ সরকারি সদিচ্ছা না থাকলে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷"
পরিযায়ী শ্রমিক আইন না মানার অভিযোগ
১৯৭৯ সালে তৈরি আইনে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রাজ্যের ও কেন্দ্রের উভয়েরই দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু কোনো সরকারই এই আইন কার্যকর করেনি বলে দাবি শ্রমিক সংগঠনের৷
ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ গায়েন ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক৷ কোভিড পরবর্তী সময়ে এই আইনটার কথা সামনে আসে৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সরকার এই আইন কার্যকর করতে পারেনি৷ উল্টোদিকে কেন্দ্র সরকার যে শ্রমকোড বা লেবার ল নিয়ে আসছে, তাতে ১৯৭৯ সালের আইনটিকে কাটছাঁট করে দেওয়া হচ্ছে৷"
অভিযোগ, রাজ্যের বাইরে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নেই৷ কোনো সরকার দায়িত্ব নিতে চায় না৷ তাই একগুচ্ছ দাবি তুলেছে শ্রমিক সংগঠন৷
আসাদুল্লাহ বলেন, "আমাদের ১২ দফা দাবির মধ্যে প্রথম হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে৷ একজন ভারতীয় নাগরিক দেশের মধ্যে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, কাজ করতে যেতে পারে৷ নাগরিক হিসেবে সেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে৷"
তিনি মনে করেন, প্রতি রাজ্যে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হলে শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে যেতে হয় না৷ এ কথা পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, সব রাজ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি৷
আসাদুল্লাহ বলেন, ‘‘রাজ্যে কাজ নেই বলেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে যেতে হচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক কোটির বেশি পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যের বাইরে গিয়েছেন৷ রাজ্যে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে৷ আগে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বিশেষ দক্ষতামূলক কাজের জন্য বাইরে যেতেন৷ এখন ঝাড়ুদার বা ধান রোয়া ইত্যাদি সাধারণ কাজের জন্য যেতে বাধ্য হচ্ছেন৷’’