ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের মুখে ইসরায়েল
১০ এপ্রিল ২০২৫এমন ঘটনার পর ইসরায়েলের বিষয়ে তদন্তের চাপ বাড়ছে।
২০২৫ সালের ২৩শে মার্চ ভোরে মুনথার আবেদ এবং তার উদ্ধারকারী দলকে দক্ষিণ গাজার রাফায় হাশাশিন এলাকায় পাঠায় জরুরি পরিষেবা সংস্থা।
তারপর শুরু হয় গুলি।
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস)-এর একজন স্বেচ্ছাসেবক প্যারামেডিক আবেদ গাজা থেকে ডয়চে ভেলেকে ফোনে জানান, "পথে আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি চালানো হয়। যখন গুলি শুরু হয়, আমি গাড়ির পিছনের কেবিনে মেঝেতে শুয়ে থাকি। এরপর আমি কিছুই শুনতে পাইনি।"
গাড়ির সামনে থাকা তার দুই সহকর্মী নিহত হন। এরপর তিনি শুনতে পান ইসরায়েলি সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। ২৭ বছর বয়সি এই যুবক জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সৈন্যরা তাকে আটক করে মারধর এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে। কয়েক ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ভোরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়া প্রথম জরুরি পরিষেবা দলের সদস্য ছিলেন আবেদ। পিআরসিএসের তথ্য অনুযায়ী, পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সহকর্মীদের খুঁজতে যাওয়া আরো কয়েকটি উদ্ধার ও সাহায্যকারী দলকেও গুলি করা হয়।
সেদিন ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ১৫ জন ফিলিস্তিনি উদ্ধারকর্মী এবং প্যারামেডিক নিহত হন। এর মধ্যে আটজন পিআরসিএসের, ছয়জন ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের এবং একজন জাতিসংঘের কর্মী ছিলেন। এরপর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ধ্বংস হওয়া যানবাহনের পাশেই একটি অগভীর কবরে তাদের মরদেহ সমাহিত করে।
জাতিসংঘ: 'অ্যাম্বুলেন্সে একের পর এক আঘাত হানা হয়েছে'
এই ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্তের দাবি উঠেছে। এই ঘটনার একটি ভিডিও প্রকাশের পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মন্তব্য নিয়ে আরো বেশি সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে, এ বিষয়ে তাদের তদন্ত চলমান রয়েছে।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক কার্যালয় ওএইচসিএ-র প্রধান জোনাথন হুইটল এইসব মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনা নথিভুক্ত করেছিলেন। ২ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "ইসরায়েলি বাহিনী যখন রাফা অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তাদের (জরুরি পরিষেবা কর্মী) রাফায় পাঠানো হচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সগুলো এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলোতে একে একে আঘাত করা হয়েছিল।"
হুইটল বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, জাতিসংঘ এবং ফিলিস্তিনি জরুরি পরিষেবাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনার পর ওই এলাকায় নিরাপদে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, "এটা আমাদের জন্য মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ছিল। এরা ছিলেন (ফিলিস্তিনি) রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং সিভিল ডিফেন্সের চিকিৎসা কর্মী, যারা তখনও তাদের ইউনিফর্ম পরে ছিলেন, গ্লাভস পরে ছিলেন।"
"জীবন বাঁচাতে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে," বলেন হুইটল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী: 'একটি সন্ত্রাসী হুমকি'
৩১শে মার্চ এক প্রাথমিক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছিল, "বেশ কয়েকটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ যানবাহন সন্দেহজনকভাবে আইডিএফ সেনাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, হেডলাইট বা জরুরি সংকেত ছাড়াই।" আইডিএফ এর দাবি, এরপরই সেনারা যানবাহনগুলো লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে।
আইডিএফ আরো বলেছিল, হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের নয়জন জঙ্গিকে তারা নির্মূল করেছে। তবে তাদের মধ্যে কেবল একজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ধারাবাহিকভাবে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক উদ্দেশ্যে বেসামরিক অবকাঠামো ব্যবহার করার অভিযোগ করে আসছে। হামাসকে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাবদ্ধ করেছে।
এরপর এই ইস্যুতে গণমাধ্যমে নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়, দাবি করা হয় মৃতদেহগুলো হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমের এই তথ্যও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তবে ৫ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে ইসরায়েলি বর্ণনার বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। এই ঘটনায় নিহত হওয়া উদ্ধারকারীদের একজন রিফাত রাদওয়ানের মোবাইল ফোন থেকে ভিডিওটি উদ্ধার করা হয়েছে।
প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মতে, ছয় মিনিটেরও বেশি সময় ধরে রেকর্ড করা ভিডিওটিতে ঘটনাস্থলে পাঠানো উদ্ধারকারী দলের একজনের শেষ মুহূর্ত দেখানো গেছে।
ফুটেজটি চলমান অ্যাম্বুলেন্সগুলোর একটির ভেতর থেকে ধারণ করা হয়েছে বলে বোঝা গেছে। এতে একটি দমকল গাড়ি এবং স্পষ্টভাবে চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে দেখা গেছে। গাড়িগুলোতে জরুরি আলো জ্বলছিল, অন্ধকারে একটি রাস্তা ধরে সেগুলো ছুটে যাচ্ছিল।
এক পর্যায়ে গাড়িগুলো রাস্তা থেকে সরে যাওয়া আরেকটি গাড়ির কাছে থামে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, উদ্ধারকর্মীদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত আলো প্রতিফলন করে এমন পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। যে অ্যাম্বুলেন্স থেকে ভিডিওটি তোলা হয়েছিল, তা থামার পর পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে গুলির শব্দ শোনা যায়, যা চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। পুরো ফুটেজেই কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল এবং এক পর্যায়ে প্রার্থনারত একজনের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
প্রাথমিক ব্যাখ্যা থেকে সরে গেছে ইসরায়েল
ভিডিওটি প্রকাশ পাওয়ার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের দাবি থেকে সরে আসে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা শনিবার সন্ধ্যায় ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে থাকা সৈন্যদের কিছু প্রাথমিক বক্তব্য ‘ভুল' ছিল এবং ঘটনাটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।
সোমবার আইডিএফ জানিয়েছে, ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে আইডিএফ প্রধান আইয়াল জামির "তদন্ত আরও গভীরভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।"
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে ঘটনাটি একটি "যুদ্ধক্ষেত্রে" ঘটেছে এবং তদন্তে "ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে এলাকায় পূর্ববর্তী সংঘর্ষের পর অনুভূত হুমকির কারণে সৈন্যরা গুলি চালিয়েছিল এবং এই ঘটনায় নিহত ছয়জন ব্যক্তিকে হামাস সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।" এই বিবৃতিতেও ছয়জনের নাম জানানো হয়নি বা বাড়তি প্রমাণও দেওয়া হয়নি।
নোট: হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইসরায়েল