পড়শি দেশে কম্পনে কতটা চিন্তা কলকাতার
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩চীন থেকে বাংলাদেশ, গত কয়েকমাসে একের পর এক ভূমিকম্প হয়েছে। সোমবার রাতে চীনের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা শতাধিক। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক আকারে। বাংলাদেশেও ছোট আকারে বারবার ভূমিকম্প হচ্ছে। পড়শি দেশগুলিতে একের পর এক ঘটনায় চিন্তা বাড়ছে কলকাতাকে নিয়ে।
কলকাতায় কম্পন
এ মাসের গোড়ায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয় উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে। ২ ডিসেম্বর এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশ। সকাল নটার কিছু পরে ভূমিকম্প হয় শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায়।
রিখটার স্কেলে ভূকম্পের মাত্রা খুব বেশি ছিল না। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির তথ্য অনুযায়ী, রিখটারে ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। বাংলাদেশের আফটারশক কলকাতায় সামান্যই টের পাওয়া গিয়েছিল। মাত্রা খুব কম হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি কিছু হয়নি।
গত মাসেও কলকাতায় এমনই অতি মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। নভেম্বরের গোড়ায় সেই কম্পনের মাত্রা ছিল খুবই কম। সেবার তীব্র কম্পন হয় দিল্লিতে, রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৬.৪।
গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ। তখন কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন অংশে কাঁপুনি টের পাওয়া গিয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্ন না থাকলেও বারবার কাঁপুনি উদ্বেগ তৈরি করছে।
মহানগরের বিপদঘন্টি
কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, যেখানে জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, সেখানে বারবার কম মাত্রার কম্পন হলেও তা বিপজ্জনক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কমবেশি ১৫০ বছর পর পর বড় আকারের ভূমিকম্প কোনো একটি এলাকায় আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সময়ের এই বৃত্ত পূর্ণ হয়েছে। ফলে সে দেশে ছয় মাত্রার অধিক কম্পন ভবিষ্যতে হওয়ার আশঙ্কা আছে। কলকাতাও এক্ষেত্রে নিরাপদে থাকবে না। বরং কম মাত্রার বারংবার কম্পন বড় বিপদের পূর্বাভাসও হতে পারে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী তুহিন ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গঙ্গার নিম্ন অববাহিকা অঞ্চল পলি দিয়ে তৈরি। কলকাতা তার মধ্যেই পড়ে। এই বৃহত্তর বদ্বীপে সেই পলি, বালি এখনো পুরো জমাট বাঁধেনি। ফলে সেটা কম শক্তপোক্ত। এ কারণে বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়।"
কলকাতা এবং হাওড়াকে নিয়ে তাই গভীর উদ্বেগের কারণ রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ সায়েন্টিফিক রির্সাচ-এর গবেষণায় দেখানো হয়েছে, দুই যমজ শহরের মাটির নীচের একটি অংশ ফাঁপা হয়ে রয়েছে। বড়সড় কম্পনের জেরে দুই শহরের তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বিপদ বাড়িয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন, যার ফলে হিমবাহ গলে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জলস্তর বেড়ে গেলে কলকাতা প্লাবিত হতে পারে। বাড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা। ফলে ভূমিকম্প ও প্লাবনের জোড়া ফলা মহানগরীর শিয়রে।
বেশি বিপদ উত্তরে
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ থেকে উত্তর কলকাতার পরিস্থিতি বেশি ভঙ্গুর। অর্থাৎ ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে উত্তরে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। বউবাজারে মেট্রো প্রকল্পের কাজ ঘিরে সেই নমুনা বারবার সামনে আসছে।
যাদবপুরের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী অর্ঘ্য চন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বউবাজারে মেট্রো রেল নির্মাণের জেরে ফাটল দেখা দিচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, কলকাতায় বড় ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি কতটা হতে পারে। আমাদের শহর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে না ঠিকই। কিন্তু যদি ভূমিকম্প হয় তাহলে পরিস্থিতি মর্মান্তিক হবে। আমাদের সেদিনের জন্য তৈরি থাকতে হবে।"
বিপর্যয় মোকাবিলা বিশেষজ্ঞ তুহিন ঘোষের বক্তব্য, "উত্তর কলকাতার নির্মাণ অনেক পুরনো। তাই মানিকতলা, ফুলবাগান, বেলেঘাটা, আমহার্স্ট স্ট্রিটের মতো এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমাদের বেহিসেবি কাজকর্ম বিপদ বাড়াচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ইন্ডিয়ান প্লেট এখনো সক্রিয়। উত্তরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই হিমালয়ের পাদদেশ ও আশপাশে ভূমিকম্প হবেই। তার আঁচ আমাদের উপর আসতে পারে।"
নগরায়নের ঝুঁকি
কলকাতায় গত কয়েক দশকে নগরায়নের গতি বেড়েছে। উড়ালপুল থেকে আবাসন, নানা ধরনের অতিকায় নির্মাণে বোঝা বেড়েছে মহানগরীর। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেলাগাম নগরায়ন শহরকে আরো বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জলাভূমি বুজিয়ে, গাছ কেটে আমাদের শহরে নির্মাণ হয়ে চলেছে। ভূগর্ভের জলস্তর ক্রমশ কমছে। জল তুলে নেয়ার ফলে মাটির নীচে অনেক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এর উপর এখানকার মাটি নরম। ফলে বিপর্যয় মঞ্চ প্রস্তুত। আমাদের সরকার, প্রশাসনের সামনেই সব হচ্ছে। এখনই সজাগ না হলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে। ভূমিকম্প তারই একটা প্রকাশ।"
পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জলাভূমির একাংশ বুজিয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। কংক্রিটে মুড়ে দেয়া হচ্ছে শহর থেকে মফস্বলের পথঘাট। এর ফলে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে ভূগর্ভে যাচ্ছে না। তাতে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। প্রশাসন সজাগ না হলে কি ভবিষ্যতে আরো বড় বিপদের কবলে পড়তে পারে কলকাতা?