প্রেম ও হত্যার দুই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় কলকাতা
প্রেম এবং তার জেরে হত্যা। তার সঙ্গে জড়িয়ে অপ্রাপ্তবয়স্করা। কলকাতার এমন দুইটি ঘটনা নিয়ে এই ছবিঘর।
অয়নের কাহিনি
গত ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর রাতে ‘বান্ধবীর বাড়ি থেকে আসছি’ বলে চলে যায় হরিদেবপুরের ২১ বছরের অয়ন মণ্ডল। তার পর থেকে তাঁর খোঁজ মেলেনি। ঘটনার দুইদিন পর অয়নের বান্ধবীর বাড়ি থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মগরাহাটে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। কিন্তু দশমীর দিন ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে রয়ে যায় ধোঁয়াশা।
কী বলছে ময়নাতদন্ত
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, ভোঁতা, শক্ত কিছু দিয়ে মাথায় আঘাতের ফলেই মৃত্যু হয়েছে তার। অয়নের বন্ধু রাজু জানায়, ''দশমীর রাতে অয়ন তার বান্ধবীর বাড়ি যায় এবং বান্ধবীর বাবার হাত থেকে বাঁচতে বান্ধবীর বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল।'' অয়ন রাজুকে জানায়, রাত দুইটা নাগাদ বান্ধবীর বাবা ঘুমিয়ে পড়লে সে বেরোবে। কিন্তু রাত দেড়টা নাগাদ রাজুকে ফোনে অয়ন কাঁদতে কাঁদতে বলে, তাকে মারধর করা হয়েছে। তার বুকে ব্যথা হচ্ছে।
গ্রেপ্তার বান্ধবী, তার বাবা, মা, ভাই
অয়ন মণ্ডলের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার বান্ধবী, বান্ধবীর মা ও ভাইকে। পুলিশ বান্ধবীর বাবা দীপক জানা, বান্ধবীর ভাইয়ের এক বন্ধু এবং পণ্যবাহী যে গাডিতে করে অয়নের মৃতদেহ মগরাহাটে ফেলে আসা হয়েছিল সেই গাড়ির চালককেও গ্রেপ্তার করেছে। পরে অয়নের বান্ধবীর ভাইয়ের আরো এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় ওড়িশা থেকে। হরিদেবপুর-কাণ্ডে ধৃত সাত জনের মধ্যে দুই জন নাবালক। তারা হলো বান্ধবীর ভাই ও তার বন্ধু।
বান্ধবীর বাড়ি ভাঙচুর
গত শুক্রবার রাত আটটার পর উত্তেজিত জনতা অয়নের বান্ধবীর বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। উত্তেজনার রেশ গিয়ে পড়ে প্রতিবেশীর বাড়িতেও। সেখানেও ভাঙচুর হয়। অয়নের পরিবারের দাবি, বান্ধবীর পরিবারই মেরেছে তাদের ছেলেকে। এলাকার মানুষ সিবিআই তদন্ত দাবি করছেন। তার জন্য সই-সংগ্রহ চলছে। অয়নের বান্ধবী সহ বাবা মা পুলিশি হেফাজতে থাকায় বাড়ির সামনে পুলিশি প্রহরাও বসাতে হয়েছে উত্তেজিত জনতার আক্রোশ থেকে বাড়িটিকে বাঁচাতে।
বান্ধবীর জন্য
হরিদেবপুরের অয়নের মা মঞ্জু মণ্ডল ছেলের জন্য পুজোয় কেনা নতুন জামা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কোনোদিনও তার অয়নের এই পোষাক পরা হয়ে উঠবে না। ফুটবল খেলত অয়ন। অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। একটি অ্যাপ চালিত বাইক-ট্যাক্সির কোম্পানিতে রাইডারের কাজ করত অয়ন। এর আগে রাজস্থানেও কাজ করতে গিয়েছিল সে। তার বন্ধুরা জানিয়েছে, বান্ধবীর অনুরোধে রাজস্থানের কাজ ছেড়ে চলে আসে সে। উপরের ছবিতে অয়নের জেতা পুরস্কার।
বর্ণালীর কাহিনি
বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় আরও একটি ঘটনা ঘটে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার শ্রীহট্ট এলাকায়। বারো বছর বয়সী বর্ণালী মালিক পাশের গ্রামের ঠাকুর দেখতে গিয়ে আর ফেরেনি। বর্ণালীর বাবা সৌমেন মালিক জানিয়েছেন, তার ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে বেলা তিনটের সময় সাইকেল নিয়ে খুড়তুতো ভাইবোনেদের সঙ্গে গ্রামেরই ঠাকুর দেখতে বের হয়। তারপর ভাইবোনদের ছেড়ে পাশের গ্রামের ঠাকুর দেখতে গিয়ে আর ফেরেনি।
মৃত্যুর পিছনে প্রেমিক, দাবি পুলিশের
কিশোরীর মৃত্যু নিয়ে পুলিশের দাবি, তিন বন্ধুকে নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করেছিল প্রেমিক। বন্ধুদের উপস্থিতিতে প্রেমিকার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতেও চেয়েছিল সেই নাবালক প্রেমিক। তাতে বাধা দেয়ায় প্রেমিকাকে ঠেলে জলে ফেলে দেয় ‘ক্ষুব্ধ’ প্রেমিক। সাঁতার না জানায় পুকুর থেকে আর উঠতে পারেনি প্রেমিকা। জলে ডুবে মৃত্যু হয় তার।
তিন নাবালক সহ গ্রেপ্তার চার
জাঙ্গিপাড়ার কিশোরী মৃত্যু কাণ্ডে চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে তিন জনই নাবালক। পুলিশের দাবি, দূর সম্পর্কের এক নাবালক আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রীর। দশমীর সন্ধ্যায় সেই প্রেমিকের আহ্বানেই পুকুর পাড়ে গিয়েছিল বছর বারোর ওই কিশোরী। পুলিশ জানিয়েছে, প্রেমিকের যৌন আবেদনে বাধা দেয়ায় নাবালিকাকে পুকুরে ফেলে তার সাইকেল নিয়ে চম্পট দেয় নাবালক প্রেমিক ও তার বন্ধুরা।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট
ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। সেখানে জলে ডুবে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। শুক্রবার জাঙ্গিপাড়া থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করার সময় পুলিশ অভিযোগ নিতে গড়িমসি করে বলে অভিযোগ করেছেন কিশোরীর পরিবারের সদস্যরা। মেয়ের হত্যায় অভিযুক্ত চার জনের গ্রেফতারের খবর শুনে কিশোরীর মা বললেন, ‘‘অপরাধীদের শাস্তি হোক, আমরা এটাই চাই।’’ উপরের ছবিটি বর্ণালীর মায়ের।
পতাকা এখনো নামানো হয়নি
তাদের মেয়ে প্রতিদিন সকালে বাড়ির ছাদে দেশের জাতীয় পতাকা তুলত আর সন্ধ্যায় নামিয়ে রাখত। দশমীর সকালেও পতাকা তুলেছিল কিন্তু তা আজও নামানো হয়নি, বলে কাঁদতে থাকেন মা সোনালি মালিক।
দুই বাবার অবস্থা
দিল্লিতে গয়নার কাজ করেন বর্ণালীর বাবা সৌমেন। মেয়ের মৃতদেহ যেদিন পাওয়া যায় সেদিনই বিনা টিকিটেই ট্রেনে উঠে পড়েন সৌমেন। মেয়ে আর ফিরবে না, কিন্তু পেট চালাতে তাকে কাজে ফিরতে হবে। তিনি সুবিচারের অপেক্ষায়। অয়নের বাবাকে শোকের মধ্যেও রুটিরুজির তাগিদে চায়ের দোকান খুলতে হচ্ছেে। তার কথায়, ''বাপ মা মেয়ে সকলে মিলে আমার ছেলেটাকে মেরেছে। আমরাও ভালোবেসে বিয়ে করেছি, একজন ভালোবাসার মানুষকে কেউ এভাবে মারতে পারে!''
মনোবিদের ব্যাখ্যা
অয়নের ঘটনা প্রসঙ্গে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''প্রেমে পরিবারের কারোর সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়া মানেই তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে তা কখনোই কাঙ্খিত নয়।'' অনুত্তমা বলেন, ''জাঙ্গিপাড়ার ঘটনাটি তদন্তসাপেক্ষ হলেও যেখানে যৌন হিংসা এবং পৌরুষের বিষাক্ত দৃষ্টিভঙ্গি আর ক্ষমতা প্রকাশের তাগিদ রয়েছে। সেখানে এই অপরাধকে শুধুমাত্র বয়স দিয়ে না দেখে অপরাধীরা মানসিক ভাবে পরিণত কি না সেটা দেখতে হবে।''
সাবেক পুলিশ কর্তার মত
সাবেক আইপিএস অফিসার সন্ধি মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ''শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে সীমাহীন ঘনিষ্ঠতা পুলিশকে মানুষের কাছে অবিশ্বাসী করে তুলেছে। অপরাধীরা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত পুলিশ। পুলিশকে আইনের শাসন চালানোর স্বাধীনতা দিতে হবে। পুলিশকে দায়িত্ববান এবং সংবেদনশীল হতে হবে।'' সন্ধির মতে, ''প্রশাসন সরাসরি কিছু না করতে পারলেও স্থানীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে পারে।''
কেন এই সহিংসতা?
সন্ধি মুখোপাধ্যায়ের মতে, ''কিশোর বয়সের এই অপরাধের জন্য ছোটো পরিবার অনেকাংশেই দায়ী। একটা সময়ে যৌথ পরিবারে বাবা-মা ছাড়াও ছোটদের ওপর কাকা, জ্যাঠা বা পরিবারের বড়দের নজরদারি ছিল। শিশুদের জীবন আজ অনেকটাই মোবাইলফোন কেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় অন্যান্য খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে শিশুমনের বিকাশের অবকাশ কমে গিয়েছে। ফলত বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।''