পশ্চিমবঙ্গ সফরে কী বার্তা দেবেন নরেন্দ্র মোদী?
২৫ মে ২০২৫কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলা ২৬ জন নিহত জওয়ার পর পাকিস্তানে অপরাশেন সিঁদুর অভিযান চালায় ভারত৷ ভারতের অভিযানের জবাবে পালটা হামলা চালায় পাকিস্তানও৷ এসব মিলিয়ে উত্তপ্ত ভারতের রাজনীতিক অঙ্গন৷ এদিকে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচন৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানা সমীকরণ বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গ প্রধানমন্ত্রী এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সফরে নিয়ে চলছে আলোচনা৷
উত্তরবঙ্গে প্রধানমন্ত্রী
২৯ মে দুপুর ১২টায় আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে এক কর্মসূচিতে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী৷ ইতিমধ্যে বৃষ্টিতে প্যারেড গ্রাউন্ডে জল জমে থাকায় মাঠ সংস্কারের কাজ চলছে৷
অপারেশন সিঁদুরের পরে এই প্রথম রাজ্যে সফর মোদীর৷ প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি রয়েছে উত্তরবঙ্গের হাসিমারা বায়ুসেনা ছাউনির কাছে৷ শিলিগুড়ি লাগোয়া চিকেনস নেক ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স-এর ক্ষেত্রে পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷
সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মোদী রাজনৈতিক সভা করতে চলেছেন৷ গত মঙ্গলবার দুপুরে আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে হাজির হন একঝাঁক বিজেপি নেতা৷ ছিলেন সাংসদ মনোজ টিগ্গা, ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মন, কালচিনির বিধায়ক বিশাল লামা৷ তারা মাঠ ঘুরে দেখার পরে শুরু হয় জল্পনা৷
বিজেপি নেতা মনোজ টিগ্গা বলেন, ‘‘অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যের পর সেনাকে সম্মান জানাতে এবং কেন্দ্রের ভূমিকা তুলে ধরতেই প্রধানমন্ত্রীর এই সফর৷ তার আগে মাঠ দেখতে গিয়েছিলাম৷’’
রাজনৈতিক সভা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী একাধিক সভা করছেন৷ তারই অংশ হিসাবে আলিপুরদুয়ারে সভা হবে৷ ২০১৬ সালের পর ফের একবার প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে সাধারণ মানুষ উচ্ছ্বসিত৷''
দেশের পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানের সঙ্গে চলছে উতেতজনাকর পরিস্থিতি৷ সেই পরিস্থিতি সামলাতে কঠোর ছিল মেদি সরকার৷ এদিকে পূর্বদিকের প্রতিবেশি বাংলাদেশে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে৷ বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথেও মোদর প্রশাসনের কূটনৈতি সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক হয়নি৷ তাই এই সীমান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী বার্তা দেন, সেদিকে নজর রয়েছে৷
তবে শুধু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নয়, স্থানীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের এই সংক্ষিপ্ত সফর গুরুত্বপূর্ণ৷ উত্তরবঙ্গ বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হলেও সেখানে কিছুটা জমি পুনরুদ্ধার করেছে তৃণমূল৷ কিছুদিন আগেই টিগ্গার ছেড়ে যাওয়া আসন মাদারিহাটে উপনির্বাচনে বিজেপির ঘাঁটি দখল করেছে রাজ্যের শাসক দল৷ সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন চা বলয়ের নেতা ও সাবেক বিজেপি সাংসদ জন বার্লা৷ প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে এই ক্ষতির মোকাবিলা করতে চাইছে বিজেপি যাতে আর জমি তারা না হারায়, এমনটাই মত রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের৷
আসছেন অমিত শাহও
উত্তরবঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরেই, আগামী ৩১ মে শনিবার রাজ্যে আসার কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের৷ তার সফরের মূল লক্ষ্য সরকারি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ৷
১ জুন হুগলির আরামবাগে একটি সমবায় সংক্রান্ত অনুষ্ঠান রয়েছে, অন্যটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মসূচি৷ বিজেপির সংগঠনের শীর্ষ নেতা শাহ দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন৷ কলকাতার নিউটাউনের হোটেলে রাজ্য বিজেপির নেতাদের নিয়ে বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে শাহের৷
আগামী বছরে এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা৷ তার আগে সামরিক বাহিনীর পরাক্রমকে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার করতে চাইছে বিজেপি, অনেকে এমনটা মনে করছেন৷ যদিও তৃণমূল তাকে আক্রমণ করতে ছাড়ছে না৷
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘ভোট এলেই তারা একটু বেশি আসেন৷ রাজনৈতিক পর্যটকের ভূমিকা নেন৷ পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি হেরেছে, বিধানসভা ভোটে হেরেছে, লোকসভা নির্বাচনেও হেরেছে প্রধানমন্ত্রী আসার পরেও৷ পশ্চিমবঙ্গে এলে বাংলার অধিকারের টাকা নিয়ে আসবেন৷ খালি হাতে আসবেন না৷’’
সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘বিহারে যখন প্রধানমন্ত্রী গেলেন, তখন সর্বদলীয় বৈঠক করলেন না, সীমান্তে গেলেন না, পহেলগ্রামে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন না৷ এসব দেখে বোঝা যায়, এদের কাছে ভোটই বড়৷’’
বিজেপি নেতা বিমলশঙ্কর নন্দ বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনিক সফরে এলেও তার একটা বাড়তি তাৎপর্য আছে৷ বিশেষত পহেলগামে হামলা ও অপারেশন সিঁদুরের পর৷ পাকিস্তানের সঙ্গে টেনশন রয়েছে, আমাদের দেশে পাক চরদের খুঁজে বার করা হচ্ছে৷ সে দিক থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সফর তাৎপর্যপূর্ণ৷’’
সরকারি সফরে রাজনৈতিক ফায়দা!
প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপির এই দুই নেতা নিজেদের ভোটের বাক্স সমৃদ্ধ করতে দলটির পক্ষে তুরুপের তাস হয়ে কাজ করেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা৷ আর তাই তাদের এই সফর বিধান সভার নির্বাচনের আগে নিজেদের পাল্লা ভারি করার চেষ্টার অংশ হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে৷
ফলে সরকারি কর্মসূচিতে রাজ্যে এলেও রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকবেই, এমনটাই অনেকের মত৷
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী এখনো বিজেপির জন্য সেরা ভোট ক্যাচার৷ অপারেশন সিঁদুরের পরে তাকে আরও বেশি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছিলেন৷ তাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের দুরমুশ করে দেন৷ এবার তাই অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিজেপি৷’’
এখনো যে মোদী-শাহ যুগলবন্দি বিজেপির সেরা টেক্কা, সেটা নিয়ে দ্বিমত করছেন না সুমন৷ বলেন, ‘‘ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলায় যুগলবন্দির একটা গুরুত্ব আছে৷ এক সময়ে সুনীল গাভাস্কার ও কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের জুটি ছিল৷ টেনিসে ছিল লিয়েন্ডার পেজ ও মহেশ ভূপতির জুড়ি৷ এক্ষেত্রে একজন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সামনে এসে আক্রমণ করবেন, আর একজন পিছন থেকে খেলাটা ধরে রাখবেন৷ গত ১০ বছরে বিজেপি যে সাফল্য পেয়েছে, সেক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী সামনে এসে ব্যাট চালিয়েছেন এবং অনেকটা পিছন থেকে গুটি সাজিয়ে বাকি বিষয়টা ঠিক করেছেন অমিত শাহ৷ এই যুগলবন্দি বিজেপিকে তো সাফল্য এনে দিয়েছে বছরের পর বছর৷ সেই সাফল্যের আশায় তারা পশ্চিমবঙ্গ এগোচ্ছে৷’’
তবে সফরটিকে পুরোপুরি রাজনৈতিক বলতে নারাজ সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি অনেকদিন আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে৷ এই সফরের সঙ্গে অপারেশন সিঁদুরের সম্পর্ক নেই৷ আর এই ধরনের সফর মানে যে রাজনৈতিক প্রচার করতে আসা, সেটাও সবসময় ভাবা ঠিক নয়৷ তবে রাজনৈতিক কারণ যে একেবারেই নেই, এমনটাও বলা যায় না৷ ফলে দুটো সম্ভাবনাই থাকে৷ আগে থেকে যে কর্মসূচি নির্ধারিত হয়ে আছে, তার সঙ্গে প্রচার জুড়ে যেতে পারে৷ মোদীর যে জনসভা আছে, সেখানে তিনি অপারেশন সিঁদুর নিয়ে বলবেন, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার৷ নির্বাচনের এত আগে বলে এটাকে ভোটের বাদ্যি তকমা দিতে আমি রাজি নই৷ ভোটের চার পাঁচ মাস আগে হলে এটা বলা যেত৷’’