পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ ‘দ্য কেরালা স্টোরি’
৯ মে ২০২৩পরিচালক সুদীপ্ত সেনের ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ হইচই ফেলেছে ভারতে। দক্ষিণের রাজ্য কেরালার প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবিতে ধর্মান্তর ও নারী পাচারের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দু ও খ্রিস্টান মহিলাদের ধর্মান্তরিত করে লাভ জিহাদ-এ উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, এমন বার্তা দিয়েছে ছবিটি।
ট্রেলার সামনে আসতেই 'দ্য কেরালা স্টোরি' ঘিরে বিতর্ক দানা বাধে। ৫ মে ছবি মুক্তি পায়। তারপর বিতর্কের পারদ চড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ
সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, এই ছবি পশ্চিমবঙ্গের কোনো প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হবে না। মুখমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘বিকৃত তথ্য দিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। একটি সম্প্রদায়কে নিয়ে সিনেমা হয়েছে। বাংলাতেও বেঙ্গল ফাইলস তৈরি করতে চাইছে।’’
রাজ্যের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে ছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে যে দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তা শান্তিশৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।
মমতার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, ‘‘বিরোধীরা সবসময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেন। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এটা কী হলো? ধর্মান্তরণের সংখ্যা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু ছবির বিষয়ে তো ভুল নেই!’’ কেরালায় ৩২ হাজার মহিলার ধর্ম পরিবর্তনের কথা গোড়ায় বলা হলেও পরে মুক্তির সময় ছবিতে সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে।
অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজ্যের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে বামেরা। সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ছবি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত স্বৈরতান্ত্রিক। বিতর্কিত ছবিটি আরো জনপ্রিয়তা পাবে নিষিদ্ধ করায়। বরং পাল্টা তথ্য দিয়ে ছবির বক্তব্যের বিরোধিতা করাই সঙ্গত।’’
সেলুলয়েডে রাজনীতি
কর্নাটকে ভোট প্রচারে গিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ছবির পক্ষে সওয়াল করেন। বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে 'দ্য কেরালা স্টোরি'কে করমুক্ত করা হয়েছে। বাম শাসিত কেরালায় ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়নি। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া এই ছবির প্রদর্শনের বিরুদ্ধে দেশের সুপ্রিম কোর্ট ও একাধিক হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো আদালত এটিকে 'ইসলামবিরোধী' বলে মনে করেনি।
অতীতে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতে এমন একাধিক ছবি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। ডান হোক বা বাম, সরকারের কোপে পড়েছে অনেক ছবি। বিজেপি শাসিত গুজরাটে নিষিদ্ধ হয়েছে 'পরজানিয়া', 'ফিরাক', 'ফনা'। 'পদ্মাবত' ছবি নিয়ে গেরুয়া শিবির আপত্তি তোলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাক স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
কিন্তু এই রাজ্যে পরিচালক অনীক দত্তের 'ভবিষ্যতের ভূত' নিয়ে আপত্তি ছিল তৃণমূল সরকারের। সম্প্রতি বিজেপির তারকা প্রচারক মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত 'প্রজাপতি'র নন্দনে ঠাঁই হয়নি। বাম আমলে সুমন মুখোপাধ্যায়ের 'হারবার্ট' বাধার মুখে পড়েছে। বাম সরকার বিদেশি 'টরাস' ছবি তুলে নিয়েছিল চলচ্চিত্র উৎসব থেকে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া
‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে সিনেমা জগতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মমতার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন বলিউডের অভিনেত্রী শাবানা আজমি। বামমনস্ক টলিউড অভিনেতা কৌশিক সেন মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।
সাম্প্রতিক অতীতে এ ধরনের বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ঘিরে। এই ছবিটি পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ হয়নি। এতে একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করা হয়েছে বলে বিজেপি বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিল।
‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে একই ধরনের অভিযোগ তৃণমূলের। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ পরিচালক বিবেক, সুদীপ্তদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, ‘‘গুজরাট নিয়ে সিনেমা করেন না কেন? গুজরাট ফাইলস, উন্নাও ফাইলস, হাথরাস ফাইলস তৈরি করলে বুঝতাম!’’
প্রচারের হাতিয়ার
ছবি নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক মানস ঘোষ। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সেন্সর বোর্ড পদ্মাবত, পাঠান নিয়ে মাথা ঘামায়। কিন্তু কাশ্মীর ফাইলস ছেড়ে দেয়। বাস্তববাদী ছবিতে যে তথ্য ব্যবহার করা হয়, তার একটা ভিত্তি থাকতে হবে। শিল্পীর স্বাধীনতা মানে গল্পের গরু গাছে তোলা উচিত নয়।’’
ছবি নিষিদ্ধ করার অর্থ সেটি ঘিরে আরো কৌতূহল জাগিয়ে তোলা। বক্স অফিসে দারুণ সফল 'দ্য কেরালা স্টোরি'। এই চার-পাঁচদিনে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেছে সুদীপ্তের ছবি, যা 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'-এর বাণিজ্যিক সাফল্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
বক্স অফিসে সাফল্য ও সরকারি আনুকূল্য, দুটিই একসঙ্গে নিশ্চিত করছেন 'প্রোপাগান্ডা' বা প্রচারমূলক ছবির প্রযোজকরা। অধ্যাপক ঘোষের মতে, ‘‘আমাদের সিনেমায় প্রোপাগান্ডার ঝোঁক বাড়ছে, তার নেপথ্যে রাজনৈতিক মদত রয়েছে। কর্নাটকে হিজাব নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। সেখানে কাল ভোট, তাই এটা কর্নাটক স্টোরিও হতে পারত!’’