পর্যটন ও পরিবেশ: ক্যাবল কার প্রকল্প নিয়ে নেপালের সংকট
পাহাড়ঘেরা নেপালে যাতায়াতের জন্য কয়েকটি এলাকায় রয়েছে ক্যাবল কার৷ পর্যটন আকর্ষণে সরকার চায় এর সংখ্যা বাড়াতে৷ কিন্তু পরিবেশবাদীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে৷ কেন?
আকাশে ঝুলন্ত পথ
এই ক্যাবল কারটির অবস্থান কাঠমান্ডুর বাইরের একটি এলাকায়৷ মূলত স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যই এটি বসানো হয়েছিল৷ পরিবেশের বিবেচনায়ও সড়কপথের তুলনায় তা কম ক্ষতিকর৷ কারণ, ক্যাবল কারের জন্য বেশি জায়গা লাগে না, বেশি জ্বালানি খরচ ,হয় না৷ কর্তৃপক্ষ এমন আরো ক্যাবল কার বসাতে চায় নেপালের বিভিন্ন জায়গায়৷ কিন্তু পরিবেশবাদীরা তা চান না৷
বন রক্ষায় লড়াই
নেপালের পূর্বাঞ্চলে তাপলেজুং পর্বতে আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কারের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার৷ এ নিয়ে চলছে প্রতিবাদ৷ তাদের আশঙ্কা দুই কোটি ২০ লাখ ডলারের এই প্রকল্প এখানকার প্রাচীন বনের ক্ষতির কারণ হবে৷ হুমকিতে পড়বে এখানকার অভয়ারণ্য, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রা৷
প্রতিবাদ ও সহিংসতা
এই প্রতিবাদটি শান্তিপূর্ণ৷ কিন্তু সব সময় তা এমন হয় না৷ জানুয়ারিতে তাপলেজুংয়ে একটি প্রতিবাদ সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল৷ চারজন প্রতিবাদকারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন৷ ২১জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন৷ এরপর পরিস্থিতি কিছুদিন শান্ত থাকলেও ফেব্রুয়ারির শেষে আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আবারও আহত হয়েছেন প্রতিবাদকারীরা৷
আরো উঁচুতে
গত দুই বছরে নেপালে পাঁচটি ক্যাবল কার প্রকল্প চালু হয়েছে৷ পাইপলাইনে আছে আরো ১০টি৷ হিমালয়কন্যা খ্যাত নেপালের সরকার পর্যটনশিল্পকে এর মাধ্যমে আরো চাঙা করতে চায়৷ ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাবে নেপালের জিডিপির ছয় শতাংশ আসে পর্যটন থেকে৷
তীর্থযাত্রা
প্রতি বছর তিন লাখ হিন্দু তীর্থযাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছান তাপলেজুং পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত পাথিভারা দেবী মন্দিরে৷ সরকারের প্রত্যাশা ক্যাবল কার চালু হলে সেখানে আরো তীর্থযাত্রী আসবেন৷ এতে পর্যটনখাত সমৃদ্ধ হবে৷ বিশেষ করে ক্যাবল কার থাকলে বয়স্কদের চলাচলের জন্য সুবিধা হবে৷
ঝুঁকিতে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত
তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন এর ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হবে৷ প্রকল্পের জন্য এরইমধ্যে তাপলেজুংয়ের তিন হাজার রডেনড্রন বৃক্ষ কেটে ফেলা হয়েছে৷ আরো ১০ হাজার কাটা পড়বে৷ এই বন লাল পান্ডা, কালো ভালুক কিংবা তুষার চিতাবাঘের মতো বিপন্ন প্রাণীদেরও আবাস৷ এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে পাহাড় ও আশেপাশের বনাঞ্চল পবিত্র হিসেবে বিবেচিত৷
উন্নয়নের নামে বন উজাড়
শুধু তাপলেজুং নয়, অন্যান্য বনাঞ্চলেও প্রতিনিয়ত গাছ কাটা পড়ছে৷ নেপালের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত চার বছরে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের কারণে দুই লাখ ৫৫ হাজার বৃক্ষ নিধন হয়েছে৷ ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন বিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক রাজেশ রায় বলেন, ‘‘নেপালে অবকাঠামোর নামে ব্যাপকভাবে বন উজাড় করা হয়েছে৷’’ এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে বলে সতর্ক করেন তিনি৷
পুলিশি নিরাপত্তা
প্রতিবাদকারীদের ভয়ে নির্মাণস্থলে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে কাজ করা হচ্ছে৷ নির্মাণকারী সংস্থার উদ্যোক্তা চন্দ্র প্রসাদ ধাকালের সঙ্গে নেপালের সরকারের সম্পর্ক নিয়েও সমালোচনা রয়েছে৷ সরকার এক্ষেত্রে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখছে বলে সমালোচনা রয়েছে৷ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ধাকার৷ জানান, ক্যাবল কার প্রকল্পের মাধ্যমে এক হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে৷
‘আমরা বাঁচবো কী করে?’
কিন্তু অন্য অনেকের জন্য এই প্রকল্প অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে৷ যেমন তীর্থযাত্রীদের ব্যাগ, লাগেজ বহনের কাজ করে এমন কয়েকশ মানুষ এতে খুশি নন৷ তীর্থযাত্রার পথে থাকা টি-স্টল সহ বিভিন্ন দোকান চালানো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও তাদের জীবিকা নিয়ে চিন্তিত৷ ৩৮ বছর বয়সি চন্দ্র তামাং বলেন, ‘‘মানুষ যদি উপর দিয়ে ক্যাবল কারে করে চলে যায় তাহলে আমরা বাঁচবো কী করে?’’
‘আমরা ঐতিহ্য বাঁচাতে লড়ছি’
প্রতিবাদকারীদের নেতা শ্রী লিনখিম লিম্বু৷ তাপলেজুংয়ে গাছ কেটে ফেলাকে নিষ্ঠুর কাজ হিসেবে অভিহিত করেন৷ স্থানীয়রা মনে করেন সরকারের উচিৎ পরিবেশ ধ্বংস না করে বনাঞ্চলের ‘ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়’ বিনিয়োগ করা৷ প্রকল্প বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা থামবেন না বলেও জানান৷ ৭৯ বছরের কেন্দ্রা সিং লিম্বু বলেন, ‘‘আমরা আমাদের ঐতিহ্য বাঁচাতে লড়ছি৷’’
এফএস/এসিবি (এএফপি)