নিরাপত্তা পেতে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ইতি চান সাংবাদিকরা
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সাংবাদিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করা নতুন কিছু নয়৷ যুগ যুগ ধরে সাংবাদিকরা হামলাকারীদের ‘সহজ টার্গেট' হিসেবে বিবেচিত৷ তবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছরের আট আগস্ট বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে৷
নতুন সরকারের তরফ থেকে একাধিকার বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে সাংবাদিকরা সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছেন৷ এমনকি বিগত সরকারের সময়ে সাংবাদিকদের উপর যে হামলা নির্যাতন হয়েছিল, সেগুলোর বিচারের কথাও শোনা গিয়েছিল৷
সাংবাদিকদের উপর হামলার সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা
পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন, সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা থামছে না৷ গত বুধবার সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গনে হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা৷ তিন দশক আগে পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর এই হামলা চালান বিএনপির নেতাকর্মীরা৷ এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন৷ এদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়েছেন এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার জাবেদ আখতার৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার উপর হামলার মূল কারণ ঈশ্বরদীর একজন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকে না চেনা৷ তাকে আমি কেন চিনি না, এই কারণে তারা ২০-২৫ জন আমাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে৷ আমি বর্তমানে কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷''
সেই ঘটনার পর স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাকে বহিস্কার করেছে বিএনপি এবং দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলেও জানিয়েছেন আখতার৷
তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনায় আমি কোন মামলা করিনি৷ তারেক রহমান আমাকে ফোন করেছেন এই কারণে নয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলাকারীদের বিচারের সংস্কৃতি নেই৷ উল্টো আমাকেই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হবে৷''
গত সোমবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের এক সংবাদ প্রকাশের জেরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে হামলার শিকার হয় দৈনিক সমকাল পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সোহাগ খান সুজন৷ হামলাকারীরা হাতুড়ি ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে সুজনকে গুরুতর আহত করেন৷ এসময় তাকে বাঁচাতে গেলে নিউজ টুয়েন্টি ফোর টেলিভিশন ও জাগো নিউজের প্রতিনিধি বিধান মজুমদার অনি, দেশ টিভির সাইফুল ইসলাম আকাশ ও সময়ের কন্ঠস্বর প্রতিনিধি নয়ন দাসের উপর হামলা চালায় তারা৷ পরে সুজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সোহাগ খান সুজন৷
আহত সোহাগ খান সুজন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে রিপোর্টের কারণে এই হামলা, সেই রিপোর্ট কিন্তু আমার পত্রিকা সমকালে ছাপা হয়নি৷ তারপরও তারা আমাকে টার্গেট করে হামলা করেছে৷''
সেই ঘটনায় স্থানীয় ক্লিনিক ব্যবসায়ীসহ ৭ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে পালং মডেল থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেছেন তিনি৷
সুজন বলেন, ‘‘কিন্তু দুঃখজনক হল এই ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ মামলার পর থেকে অভিযুক্তরা কৌশলে হুমকি ধামকি দিয়ে চলছেন ও বিভিন্ন জায়গায় অপপ্রচার চালাচ্ছেন৷''
এ ব্যাপারে পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যথেষ্ট চেষ্টা চালাচ্ছি৷ আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে৷ আসামীর গা ঢাকা দেওয়ায় তাদের ধরতে একটু সময় লাগছে৷''
শুধু ঢাকা আর শরীয়তপুর নয়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে পেশাগত কাজে যাওয়ার পথে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার গণশ্যামপুর এলাকায় সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম, মো. আলাউদ্দিন, আব্দুল মালেক নিরব ও ফয়সাল মাহমুদের ওপর মুখোশধারীরা হামলা চালায়৷ একপর্যায়ে তাদেরকে গুলি করলে তা লক্ষ্যচ্যুত হয়৷ ফলে তারা প্রাণে রক্ষা পান৷ পেশাগত কাজ করার সময় সাংবাদিকের ওপর হামলার প্রতিবাদে সেখানে মানববন্ধন হয়েছে৷ এমনকি ঢাকার পূর্বাচলে বানিজ্য মেলার শেষ দিনে ৩১ জানুয়ারি যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন জয়ের উপর হামলা হয়৷ এই ঘটনায় তিনি ৫ জনের নামসহ অজ্ঞাত ২০/২৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন৷ এই হামলার ঘটনায় পুলিশ চারজনকে আটক করলেও পরে তাদের ছেড়ে দেন৷
ভোলার লালমোহনে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার লালমোহন উপজেলা প্রতিনিধি নাইমুল ইসলাম সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে গুরুত্বর আহত হয়েছেন৷ তাকে লালমোহন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ ভোলা শহরে তাবলীগ জামায়াতের জোবায়ের সমর্থিত ওলামা মাসায়েখ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাদ বিরোধী সমাবেশ চলাকালে ২৫ ডিসেম্বর স্বেচ্ছাসেবীদের হামলার শিকার হয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভোলা জেলা প্রতিনিধি ইউনুছ শরীফ৷ সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মাদারীপুরে ৩ সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ গত ২ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে মাদারীপুরে শহরের কুলপদ্দি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে৷ আহত সাংবাদিকরা হলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাদারীপুর জেলা প্রতিনিধি বেলাল রিজভী, বাংলাদেশ টুডের জেলা প্রতিনিধি এমদাদ খান এবং দৈনিক দেশকালের সাংবাদিক শাহাদাত হোসেন জুয়েল৷
এই ঘটনাগুলো ছাড়াও সম্প্রতি আরও কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ গত জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী ছাত্রজনতার গণআন্দোলনের সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক হতাহত হয়েছেন৷
‘সরকারের আশ্বাসেও হামলা বন্ধ হচ্ছে না'
সাংবাদিকদের উপর হামলা প্রসঙ্গে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক নারী বিষয়ক সম্পাদক ও আমার দেশ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার মাহমুদা ডলি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের৷ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এগুলো বন্ধ হচ্ছে না৷ যদিও এখন সাংবাদিকরা কিন্তু স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন৷ নিউজ বন্ধ করতে বিশেষ জায়গা থেকে কোন ফোন আসে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি আমরা তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি৷ তিনি আশ্বাস দিয়েছেন শুধু এই সময়ে নয়, বিগত সময়েও সাংবাদিকদের উপর যে হামলা হয়েছে তিনি তার বিচারের ব্যবস্থা করবেন৷ এরজন্য একটু সময় লাগবে৷ তিনি আমাদের সহযোগিতাও চেয়েছেন৷ আইন উপদেষ্টা বলেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে হত্যা মামলা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে সাংবাদিকদের নাম বাদ দেওয়া হবে৷ এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক খবর৷''
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ বা প্রশাসন যদি ঠিকভাবে কাজ না করে সেটা কিন্তু সংবাদ মাধ্যমেই তুলে ধরা হয়৷ রাজনৈতিক দল, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সবাই নিজেদের মতো করে দেশ চালাতে চায়৷ এই পরিস্থিতির মধ্যে সাংবাদিকরাই দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন৷ তখন তারা টার্গেটে পরিনত হন৷ গণতন্ত্র সঠিকভাবে চললে সাংবাদিকতাও স্বাধীন থাকতে হয়৷ আমরা আশা করতে চাই গত ১৫ বছরে মিডিয়ার উপর যেভাবে দমন পীড়ন চালানো হয়েছে সেখান থেকে সরে এসে বর্তমান সরকার সাংবাদিকতাকে স্বাধীন ও মুক্তভাবে চলার সুযোগ দেবেন৷''
বিচারহীনতার সংস্কৃতি
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক নারী বিষয়ক সম্পাদক ও দেশ রুপান্তর পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার তাপসী রাবেয়া আঁখি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই সাংবাদিকরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছেন৷ আমরা দেখছি, এখনও সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন৷ আশা করব, বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে৷''
সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমীন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এখন সাংবাদিকদের উপর যে হামলার ঘটনা ঘটছে, সেটা কোনভাবেই কাম্য না৷ সরকারের উচিৎ হবে দ্রুত এসব হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা৷ বিগত সরকারের আমলে যেটা হয়েছে, সেটা তো এই সরকারের সময় চলতে পারে না৷''
সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)' তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘‘বাংলাদেশে ৪ জন সাংবাদিক আটক হয়েছেন৷ এই চার সাংবাদিককেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থক হিসেবে দেখা হয়েছে৷''
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে এসব আটকের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে৷ এতে লেখা হয়েছে, ‘‘যেসব সাংবাদিকের প্রতিবেদনকে হাসিনাপন্থি হিসেবে দেখা হয়েছে, তাদের অনেকেই পরে অপরাধমূলক তদন্তের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন৷ কারাবন্দি সাংবাদিকদের সংখ্যার ভিত্তিতে সিপিজের করা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ১৪তম স্থানে রয়েছে৷''
দীর্ঘদিনের সমস্যা, সমাধান কোথায়?
গত বছরের মে মাসে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)'-এর ‘প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে' দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অবস্থা আফগানিস্তানের চেয়েও খারাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল৷ এই সূচকে বিশ্বের গণমাধ্যমের অবস্থা যে ২০টি দেশে সবচেয়ে খারাপ তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান৷
আরএসএফের বিবেচনায় বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল আজারবাইজান, নিকারাগুয়া ও রাশিয়া৷ ২০০৯ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১ তম৷ সেই বিবেচনায় ১৫ বছর পর ২০২৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৪ ধাপ অবনতি হয়ে হয়েছে ১৬৫তম৷ একমাত্র ২০১৬ সাল ছাড়া প্রতি বছরই বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে৷
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর হিসাবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৩৬৫ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ হত্যার শিকার হয়েছেন দুইজন৷ এ ছাড়া ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ জন৷
আর আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০২৩ সালে ২৯০ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন৷
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সব সরকারের সময়ই সহজ টার্গেটে পরিনত হই৷ এটা কোনভাবেই কাম্য নয়৷ আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব হামলার বিচার দাবি করেছি৷ আমরা চাই, আজ থেকে আর একজন সাংবাদিকও হামলা বা মামলার শিকার হবে না সরকারের পক্ষ থেকে এই ধরনের ঘোষণা দেওয়া হোক৷''