নারীর জন্য বদলে যাওয়া সময়
২২ জুন ২০২৫আমি সিটে বসা মাত্র এক লোক বলে উঠলো, ৫ আগস্টের পরতো সবারই হেদায়েত হওয়ার কথা। তারপরও যাদের হেদায়েত হয় নাই,তাদের হেদায়েত হোক।''
স্বগতোক্তির মতো বলা। মধ্যবয়সি পুরুষ। প্যান্ট-শার্ট আধুনিক বেশভূষা।
আমার ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে লোকটি বলল,‘‘আমি কি কিছু ভুল বললাম, ভাই?'' তার কথায় বিনা প্রশ্নে একমত হওয়া ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। প্রশ্ন করার সাহস নেই, আমরা বাসে উঠামাত্র কথাটা তিনি কেন বললেন,কাকে বললেন?
অথচ আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমার সালোয়ার-কামিজ ওড়নাকে তার যথেষ্ট শালীন মনে হয়নি, কিংবা সাথে থাকা সহোদর ভাইকে অন্য কিছু ভেবে আমার উদ্দেশ্যেই সে কথাগুলো বলেছে। প্রতিবাদ দূরে থাক, প্রশ্ন করে জানতে চাইলেও আমার হয়তোবা সম্মান রক্ষা করে ফেরা হতো না৷
৫ আগস্টের পর দেশব্যাপী যে ভেন্ডালিজম, যা থেকে রক্ষা পায়নি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, ভাস্কর্য, মাজার এমনকি কবর পর্যন্ত তার সবকটির পেছনে হয়তোবা রাজনৈতিক কারণ ছিল৷ কিন্তু এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সবচেয়ে সহজ শিকার হয়েছে নারী। এর অধিকাংশই বিনা কারণে হয়েছে।
পট পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল নারীর। নেতৃত্বে ছিল নারীরা৷ শিক্ষার্থী থেকে গৃহবধূ, অভিনয় শিল্পী থেকে শিক্ষক। প্রায় সমান্তরাল উপস্থিতি ছিল পুরুষের। কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে নারীরা সর্বাগ্রে পরিণত হলো আক্রমণের সহজ লক্ষ্যে৷ কখনো পোশাকের জন্য, কখনো রাস্তায় একা চলার জন্য, কখনো অকারণে, কিংবা এমন কোনো কারণে যা একেবারেই তুচ্ছ।
কেন একটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় মাশুল নারীদের দিতে হচ্ছে? বলা বাহুল্য, পরিবর্তনোত্তর পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে যারা প্রভাব বিস্তার করেছে, কিংবা সমাজের সেই অংশটির আধিপত্য এর জন্য দায়ী,যারা নারীদের অগ্রগামিতাকে মেনে নিতে পারছে না।
কিংবা এটি হয়েছে হয়তোবা সামগ্রিক অন্ধত্ব, মূর্খতা অথবা জাতিগতভাবে ব্যক্তি অবদমনের ফলে। নইলে নারীকে হেনস্থা করার ব্যাপারে কেন নারী-পুরুষ উভয়েরই একরকম পুরুষতান্ত্রিক চেহারা উন্মোচিত হয়?
সাজগোজের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় উপকরণ টিপ।এই টিপ আমার সাজগোজের আভিজাত্য, আমার প্যাশন। আমার পরিচিতিও। ৫ আগস্টের কয়েকদিনের মধ্যেই আমি টিপ পরা বাদ দিলাম। বাদ দিলাম, কিংবা বলা ভালো, বাদ দিতে বাধ্য ভালো হলাম। খুব সরল সাদাসিধা প্রশ্ন,কেন টিপ পরলে কেউ খুলে নেয়? কিংবা টিপ পরলেই মব হয়,যেমনটি পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ বাজার লিখেছিল? মোটেই তা নয়।
বরং এই টিপ পরা, শাড়ি পরা যা কিছু বাঙালিয়ানা, তাকে নতুন করে সমীকরণকৃত করলো ‘শাহবাগী' ট্যাগিং দিয়ে। এবং ট্যাগিংয়ের রাজনীতির এই কালে বহুল প্রচলিত পর্দার বাইরের যে পোশাক আর সাজগোজের জন্য যে কোনো নারীকে যে কোনো জায়গায় বুলিং বা মবের শিকার হওয়ার এক উর্বর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই সমাজে। ফলে, সেল্ফ সেন্সরশিপে আমি আমার দীর্ঘদিনের ফ্যাশন এবং প্যাশনকে ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম।
একটি দেশের, এবং তা প্রিয় জন্মের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমি, সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের দীর্ঘদিনের অভ্যাস আর প্যাশনের সাথে এরকম ‘কম্প্রোমাইজ' কতটা বেদনাদায়ক তা কেবল ভুক্তভোগীই অনুভব করতে পারে।
এই সেল্ফ সেন্সরশিপে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বা হয়েছেন দেশের প্রায় সকল নারী। এমন নয় যে, পাশ্চাত্য কিংবা বর্তমানে বহুল প্রচলিত পোশাক না পরলেই সে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। কিন্তু তৈরি হয়েছে এক আতঙ্কময় ভীতিকর পরিবেশ, তাতে কে কোথায় কোন কারণে, হোক তা পোশাক কিংবা একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া- নারী কখন মবের সম্মুখীন হবে কেউ জানে না।
এই কৌতুহলও খুব স্বাভাবিক এই মব তৈরিকারীরা কি সমাজের বাইরের কেউ? কিংবা রাতারাতি জন্ম নিয়েছে? নিশ্চয়ই তা নয়। দীর্ঘদিন লালন-পালনের পর এরা স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক শক্তির আধিপত্য নারী বিদ্বেষকেই উসকে দিয়েছে আর তৈরি হওয়া উপযোগী উর্বর ভূমিতে সেই শক্তি আরো উদ্ধত আর হিংস্র হয়েছে।
সবচেয়ে হতাশার কথা, এই সময়ে, এই বিচারহীন যথেচ্ছাচারের সময়ে যখন নারীরা যে কোনো তুচ্ছ কারণে আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে, তখন জন মানসিকতাও তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। কিংবা হয়তো এই নারীবিদ্বেষ বিদ্যমান ছিল, শুধু পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশ করেছে।
সামাজিক মূল্যবোধ আর শালীনতা গ্রাস করা এই পরিস্থিতি তো একদিনে তৈরি হয়নি, বরং একটি জাতি দিনের পর দিন নানাভাবে অবদমিত হতে হতে এমন অসহনশীল আর অশান্ত হয়ে উঠেছে। আর এর সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে নারী। তার পোশাক নিয়ে,তার বাঙালিয়ানা নিয়ে,তার যৎসামান্য স্বাধীন পথচলা নিয়ে।
আর এই দেশের নারীরা আদৌ জানে না এর থেকে মুক্তির উপায় কী,আর কীভাবে এবং কবে তা সম্ভব।