ধাপার অবস্থাও শোচনীয়, যে কোনো সময় বিপর্যয় হতে পারে
সম্প্রতি হাওড়ার বেলগাছিয়ায় আবর্জনার চাপে এলাকায় ধস নামে। কলকাতার আবর্জনা ফেলার জায়গা ধাপার অবস্থাও শোচনীয়।
ধাপার অবস্থা
ধাপায় প্রতিদিন চার হাজার টন আবর্জনা ফেলা হয়। সারা কলকাতার আবর্জনা তো বটেই, তার উপরে বিধাননগর, নিউ টাউন, নবদিগন্ত, পানিহাটির আবর্জনাও ফেলা হয়। এখন ঠিক হয়েছে, হাওড়ার আবর্জনাও ধাপায় ফেলা হবে। ফলে ধাপার উপর চাপ আরো বাড়বে। এই আবর্জনার ফলে এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস বের হয়।
আগেই সতর্ক করা হয়েছে
ধাপা নিয়ে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন। তারা জানিয়েছিল, ধাপা থেকে প্রতিবছর ১৬ দশমিক আট লক্ষ কিলোগ্রাম মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয়। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুন্যাল(এনজিটি)-কে রাজ্য সরকার ২০২৩ সালে জানায়, ধাপার ২০ শতাংশ আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। বাকিটা করতে তিন বছর লাগবে। ধাপায় জঞ্জাল ছিল ৪০ লক্ষ টন।
আগুন জ্বলতে থাকে
বেশ কয়েক বছর আগে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, ধাপার আগুন কখনো নেভে না। আশপাশের ৩০ হাজার মানুষ কী শোচনীয়ভাবে বেঁচে আছেন সেই বিবরণও ছিল। এখন সেই মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। ধাপার জঞ্জালের আগুন এখনো আগের মতোই জ্বলছে। তাতে চরম বায়ুদূষণ হচ্ছে।
চাপ বাড়ছে
ধাপার পাশে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে বিরাট বিরাট বহুতল বাড়ি হয়েছে ও হচ্ছে। দোকান এবং আবাসনে ভরে গেছে জায়গাটা। ফলে মাটির উপর চাপ বাড়ছে। মাটির ধারণ ক্ষমতা কমছে। বহুবছর আগে থেকেই ধাপার ধারণ ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এখন ২৫ একর জমিতে প্রক্রিয়াকরণের কাজ হয়। ৩৫ একর জমিতে জঞ্জাল ফেলা হয়। পরিবেশবিদরা বলছেন, অবিলম্বে বিকল্প জায়গায় আবর্জনা না ফেললে বিপর্য়য় অনিবার্য।
৩৫ একরে এই চাপ নেয়া সম্ভব?
মাত্র ৩৫ একর জমিতে কলকাতা, হাওড়া, বিধাননগর, নিউ টাইন, পানিহাটি-সহ বিপুল এলাকার আবর্জনা এসে পড়ছে। সেই চাপ আর কতদিন নিতে পারবে ধাপা? পুরমন্ত্রী ও কলকাতার মেয়ার ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, আরো ৬০ একর জমি নেয়া হবে। কিন্তু সরকারি কাজের দীর্ঘসূত্রিতার কথাও সকলের জানা ।
বসতি এলাকায়
ধাপার আশেপাশে বহু বসত বাড়ি রয়েছে। বেলগাছিয়ার মত জমিতে ধস নামলে তাঁদের কী পরিস্থিতি হবে সেই আশঙ্কাও করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের যোগাযোগের রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। তাও ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয়দের। সবচেয়ে বড় কথা, এরকম চরম দূষিত অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে কেন মানুষ থাকবেন সেই প্রশ্নও উঠেছে।
বর্জ্য কেন আলাদা করা হয় না?
পচনশীল বর্জ্য প্রক্রিয়াকারণ করে তার থেকে তৈরি হয় সার । অন্যদিকে যেগুলি পচনশীল নয় এমন বর্জ্যও বিভিন্ন ভাবে প্রক্রিয়াকরণ হতে পারে । তবে কলকাতায় উৎস থেকে বর্জ্য পৃথকীকরণ পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা করা হলেও সেই অর্থে তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। ফলে একই জায়গায় দুই ধরনের বর্জ্য গিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি তাতে আরো জটিল হয়।
'কলকাতা ধসপ্রবণ হয়ে গেছে'
নদী ও জল সংরক্ষণবিদ তাপস দাস বলেন, 'ভূগর্ভস্থ জল যে গঙ্গা থেকে জোয়ারের সময় ঢুকছে ও ভাটার সময় বের হচ্ছে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের কলকাতায় মাটির নিচে জল কিছু জায়গায় বেড়েছে। অনেকে জায়গায় কমেছে। জল বাড়ার কারণ নোনা জল বৃদ্ধি। এই জল ওঠা নামার ফলে কলকাতার অনেক জায়গা ধসপ্রবণ হতে চলেছে।
ভূবিজ্ঞানী যা বলছেন
ভূবিজ্ঞানী সুজীব কর বলেছেন, ''বহুতল বাড়ি আমাদের বিপদ ডেকে আনছে। মাটির তলার জল উত্তোলনও বিপজ্জনক। ভূগর্ভস্থ জল নিয়ে আমাদের সার্বিকভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। নয়তো বিপদ এড়ানো যাবে না। ধাপায় আগে বিদ্যাধরী নদীর প্রবাহপথ ছিল। সেই কারণে এই মাটিতে লবন বেশি। মাটি ঝুরঝুরে। মিথেন গ্যাস সেখানেও তৈরি হয়। ফলে অগ্নিসংযোগও ঘটে মাঝেমধ্যে। এখানেও যদি নজরদারি না থাকে তাহলে বিপদ বাড়বে।''
'পরিস্থিতি খুবই খারাপ'
পরিবেশ প্রযুক্তিবিদ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ বলেন, ''চার দশক আগে ধাপাতে যে বর্জ্য জমা করার জায়গা এবং তা প্রক্রিয়াকরণ করার জন্য যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। যেকোনো সময় এই হাওড়ার মত ভূমিধস হতে পারে। এখনো পর্যন্ত চার মিলিয়ন টন বর্জ্য জমা হয়েছে। গড়ে চার হাজার টন করে প্রতিদিন কলকাতার বর্জ্য জমা হচ্ছে। বর্জ্য আলাদা করতে হবে। নয়তো বায়ো গ্যাস তৈরি সম্ভব নয়।''
এক বছরের মধ্যে করতে হবে
সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ বলেছেন, ''জাতীয় পরিবেশ আদালত বলেছিল, ২০২৪ এর মধ্যে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ শেষ করতে হবে। এখনো তা হয়নি। মাত্র অর্ধেক কাজ হয়েছে। তাই বায়োমাইনিং দরকার। যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিধস হতে পারে। বৃষ্টি হলে ভূমি ধস হয়ে একটা বিস্তীর্ণ এলাকা দূষিত হতে পারে। এক বছরের মধ্যে এই কাজ করা দরকার।''
স্থানীয় বাসিন্দার কথা
স্থানীয় বাসিন্দা নিমাই মন্ডল বলেন, ''এই রাস্তা ঘটকপুকুরে চলে গিয়েছে। ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাঁধ দেয়া রয়েছে। অনেক কৃষকের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা চাষবাস করতে পারছেন না।''
'রাস্তা খারাপ হয়েছে'
স্থানীয় বাসিন্দা শিবানী মন্ডল জানিয়েছেন, ''রাস্তা খারাপ হয়েছে। জমি উঁচু হয়েছে। চাষের জমি নষ্ট হচ্ছে।''
'চাষ হচ্ছে না'
কৃষক দীপক মালিক বলেছেন, ''জমিজমার মাপ নেয়া হয়েছে। তারপর কাজ কিছু এগোচ্ছে না। ধাপার জল ঢুকে চাষবাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লাল জল দিয়ে চাষ হচ্ছে না। এখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত লাল জল ছড়িয়ে পড়েছে।''