দেবী দুর্গার চুল বানান মুসলিমরা
কলকাতার পাশে হাওড়ার পার্বতীপুরে কয়েক পুরুষ ধরে দেবী দুর্গা এবং অন্য দেব-দেবীর মাথার চুল বানাচ্ছেন মুসলিম কারিগররা।
দেবী দুর্গার চুল
হাওড়া জেলার ডোমজুড় ব্লকের পার্বতীপুর গ্রাম। রাস্তার দু-ধারে চোখে পড়বে সারি দিয়ে রঙিন পাট শুকোতে দেওয়া রয়েছে। ওগুলো আসলে পাটের চুল। দুর্গাপুজার অর্ডার, তাই কাজ চলছে জোরকদমে।
৮০ জন ওস্তাগর
পার্বতীপুর গ্রামের ৮০ ঘর মানুষ এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। এই ৮০ জন ওস্তাগরের অধীনে গড়ে ২০ জন করে শ্রমিক কাজ করে।
সফিক আলির কথা
আশি বছর ছাড়িয়েছেন শেখ সফিক আলি। এককালে এই পেশায় থেকেই সংসার চালিয়েছেন, সন্তান লালন করেছেন। বয়সের ভারে এখন আর কাজ করেন না। এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন সফিক। বললেন, তখন তোমাদের চাচিরা আজান দিলেই উঠে পাট শুকোতে দিত, আমাদের ছেলের বউরা এখন নয়টার সময় ঘুম থেকে ওঠে, এই ব্যবসা কী করে করবে?
হুগলির পাট রঙ করা হয়
এই ব্যবসার প্রধান কাঁচামাল পাট। হাওড়া আর পাশের জেলা হুগলি থেকেই মূলত আসে সেগুলি। তারপর সেই পাট ভাটিতে সেদ্ধ করে রঙ করা হয়।
শুকাচ্ছে পাট
রঙ করার পর রোদে শুকোতে দেওয়া হয়। দুর্গাপুজোর সময় এই ব্যবসার চাহিদা থাকে তুঙ্গে এবং সেই সময়টাই বর্ষাকাল। কাজেই পাট শুকনো করার সময় বরুণদেবের সঙ্গে একটা মানসিক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে এদের। বৃষ্টি নামলেই পণ্ড হবে সকল পরিশ্রম।
পেরেকের চিরুনি
পাটের চুল ভালোভাবে শুকিয়ে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট মাপ অনুযায়ী কেটে চুলগুলিকে এই পেরেকের চিরুনির মধ্যে দিয়ে চালান করা হয়।
দেবদেবীর কেশসজ্জায়
ঠিক এভাবেই বহুবছর ধরে কাজ করে আসছেন ওস্তাগররা। নিপুন হাতে পাটকে চুলের রূপ দেন। হিন্দু দেবদেবীর কেশসজ্জায় এই মুসলিম ওস্তাগররা জড়িয়ে রয়েছেন কয়েক পুরুষ ধরে।
চুল তৈরি হচ্ছে
পেরেকের চিরুনি দিয়ে চুল বাছাই হয়ে যাবার পর চুলগুলো ঠিক এমন বিন্যস্ত রূপ নেয়।
কোঁকড়া করার জন্য
যে চুলগুলোকে কোঁকড়া করতে হয় সেগুলোকে এই ভাবে পাটকাঠিতে পেঁচিয়ে রাখতে হয় অনেকটা সময়।
লম্বা প্রক্রিয়া
এরপর সেগুলোকে আবার রঙে ডুবিয়ে রাখতে হয়। এ এক লম্বা প্রক্রিয়া।
চুল শুকাবার জন্য
শুকনো করার জন্য লাগে প্রশস্ত জায়গা। যে জায়গার অভাব দিনদিন প্রকট হয়ে উঠছে। এক চুল ব্যবসায়ীর কথায়, একটা সময় মাঠে ঘাটে মেলে রেখেই পাটের চুল শুকোতেন তারা। এখন সে সুযোগ কমে আসছে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
শেখ রশিদ আলি জানান, তার পুর্বপুরুষের হাত ধরেই পার্বতীপুরে এই পাটের চুলের কারবার গড়ে উঠেছিল। বললেন, ''পরবর্তী প্রজন্ম এত পরিশ্রম আর ময়লা কাজ করতে আগ্রহী নয়। আমি যে কয়দিন আছি চলছে, তারপর আমাদের ব্যবসা বন্ধই হয়ে যাবে।''
পেশা ছাড়বে পরের প্রজন্ম?
ফরিদুল ইসলামের তিন ছেলে এক মেয়ে। ফরিদুল চান না তার পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসুক। ''নিজেরা যে পরিশ্রম করে ওদের পড়ানোর চেষ্টা করেছি, যদি অন্যকিছু করতে পারে সেটাই ভালো।''
মজুর দিয়ে কাজ
পরবর্তী প্রজন্মের ইচ্ছেটা শোনা গেল। তারা চায়, অন্য মজুর দিয়ে এই ব্যবসা টেনে নিয়ে যেতে। নিজের হাতে কাজ করতে গেলে এই পেশায় বড় নোংরা ঘাঁটতে হয়, নিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে পাটের আঁশ ফুসফুসে বাসা বাঁধে।
চাহিদা ভালো
তবে মিরান তার ব্যবসা নিয়ে বেশ আশাবাদী। গত দুইবছরে করোনার জন্য ব্যবসা ভালো হয়নি। এবছর মালের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এখান থেকে দেশের নানান জায়গায় পাটের চুল পৌঁছায়। মিরান জানালেন, এই কাজ তারা ছাড়া কেউ করতে পারবে না।