দুর্নীতি ও দমনের উপায় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভাবনা

বাংলাদেশে দুর্নীতির মূল কারণ আমার বিবেচনায় দুইটি৷ একটি স্বজনপ্রীতি, আরেকটি অর্থলোভ৷ দুর্নীতি পৃথিবীর কোথাও একেবারে বন্ধ হয় না৷ কিন্তু দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় যদি ক্ষমতা এবং দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেরা অর্থলোভ ও স্বজনপ্রীতি- এই দুইটিকে পরিত্যাগ করে৷ দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে এটা আগে দেখিনি, এখনো দেখছি না৷ প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি চেহারা বদলায়নি, দুর্নীতিকারীর চেহারাগুলো বদল হয়েছে৷

দুর্নীতির প্রবণতা আগের মতোই আছে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং বেড়েছে৷ স্বার্থের দ্বন্দ্ব দুর্নীতির বড় অনুঘটক৷ সেটি তো এখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রকাশ্যে দৃশ্যমান৷ বাংলাদেশে দুর্নীতিতে প্রতিকারের কথা ভাবা হয়, প্রতিরোধ নয়৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো রাষ্ট্র পূরণ না করে শুধু দুদক দিয়ে দুর্নীতি দমন করা যাবে না৷ কর পরিশোধের পরও যখন রাষ্ট্র মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন দুর্নীতি হবেই৷

সৎ ও যোগ্য অফিসারদের মূল্যায়ন করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে দুর্নীতি কমে আসবে৷ দুর্নীতিতে যুক্ত অফিসারদের চিহ্নিত করে গুরুত্বহীন পদে বসাতে হবে, বিশেষ করে সেবামূলক কোনো পদে তাদের কিছুতেই বসানো যাবে না৷ তবেই দুর্নীতি কমবে৷ আর সিবিএ (সেন্ট্রাল বার্গেইনিং এজেন্ট) বন্ধ করা গেলে এ ক্ষেত্রে বড় সুফল পাওয়া যেতে পারে৷ দলীয় লেবেলে এদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যে অফিস-আদালতের স্বাভাবিক কাজ পরিচালনা করা দূরূহ হয়ে পড়ে৷

দুর্নীতির মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগে পক্ষপাত৷ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ অনুসারে দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারে৷ একইসাথে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে সরকারি সেবায় স্বচ্ছতা বাড়বে৷

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুর্নীতি ছিল৷ বিএনপি সরকার বলছে তারা আসলে দুর্নীতি করবে না৷ প্রকৃতপক্ষে সবাই দুর্নীতি করে৷ তবে বর্তমানে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেশি, কারণ এখন কোনো সরকার নেই৷ আমার কাছে মনে হয় নতুন সরকার আসলে দুর্নীতি কিছুটা কমবে৷

বর্তমানে দুর্নীতি সব দিকে হচ্ছে৷ আগেও ছিল, এখনো আছে৷ দুর্নীতি কমাতে হলে মানুষের মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে৷ সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদেরকে বয়কট করতে হবে৷ টাকার বান্ডেল এক ধরনের নেশা, এ নেশায় পড়ে তাই অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায়৷ আগেও ছিল, এখনো আছেন তবে কিছুটা কম বলে মনে হয়৷

এখন তো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে দায়িত্বে৷ তাদের মূল দায়িত্ব কিছু সংস্কার আর একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে যাওয়া৷ তাই দুর্নীতির অবস্থা মূলত নিরুপণ করা যাবে রাজনৈতিক সরকার এলে৷ কারণ আমাদের রাজনৈতিক সরকারের নৈতিক অবস্থান ও সুশাসনের ওপর নির্ভর করবে দেশের দুর্নীতির অবস্থা৷

দুর্নীতির হাত বদল হয়েছে কেবল, মানুষের অসৎ পথের আয়ের আগ্রহ কমেনি৷ যতই অভ্যুত্থান হোক না কেন ব্যক্তি পর্যায় থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন৷ সাথে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সুষ্ঠ ব্যবহার প্রয়োজন৷

বর্তমানে দুর্নীতির অবস্থা গত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের তুলনায় অনেক কম৷ আগে পুলিশের কাছে গেলে টাকা দিয়ে কাজ করাতে হতো৷ এখন একটা সাধারণ জিডি করতে গেলেও কোনো টাকা খরচ হয় না৷ দুর্নীতি কমাতে হলে সবার প্রথমে যে রাষ্ট্রের কর্তা তাকে অনেক বেশি স্বচ্ছ হতে হবে৷ রাষ্ট্রের প্রধান যখন আইন মেনে চলার বিষয়ে কঠোর হবেন, তখন দুর্নীতি অনেকটা কমানো সম্ভবত হবে৷