দিল্লিতে আপ বিদায়, জয় বিজেপির
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়৷ দুই দফায় ক্ষমতায় থাকা আপ ও বিজেপির মধ্যে সরাসরি লড়াই ছিল৷ তৃতীয় শক্তি হিসেবে ছিল কংগ্রেস৷ এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে বিপুল জয় পেয়েছে বিজেপি৷
'ডাবল ইঞ্জিন' দিল্লিতে
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে বারবার শোনা গিয়েছে 'ডাবল ইঞ্জিন সরকার' শব্দবন্ধ৷ অর্থাৎ কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপি সরকার৷ বহু বছর পর তার সেই স্বপ্ন পূরণ হল রাজধানীতে৷ দিল্লি বিধানসভায় নিরঙ্কুশ পরিষ্ঠতা পেল পদ্ম শিবির৷
বুথ ফেরত সমীক্ষায় এমনই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল৷ শনিবার সকালে ইভিএম খোলার পর থেকেই ট্রেন্ড স্পষ্ট হয়ে যায়৷ ঘড়ির কাঁটা যত এগোয়, বিজেপি ও আপের ব্যবধান বাড়তে থাকে৷ এর আগের দুটি বিধানসভা নির্বাচনে ৬০টির বেশি আসন জিতেছিল কেজরিওয়ালের দল৷ কিন্তু এ দিনের গণনায় কখনোই ৩০-এর ঘরে ঢুকতে পারেনি আম আদমি পার্টি৷
গত বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র আটটি আসনে জয় পেয়েছিল বিজেপি৷ তার আগেরবার ফল ছিল আরো শোচনীয়, মাত্র তিনটি আসন জিতেছিল তারা৷ সেখান থেকে এ বার পঞ্চাশের আশপাশে পৌঁছে গিয়েছে গেরুয়া ব্রিগেড৷ শুধু তাই নয়, একের পর এক ইন্দ্রপতন ঘটিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে সরকার গড়ে চলেছে মোদীর দল৷
১০ বছর ক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টির মুখ অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জেলে যাওয়ার পর বলেছিলেন, জনতার আদালতে জয়ী হলে তিনি ফের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন৷ কিন্তু নয়াদিল্লি আসনে হেরে গিয়েছেন আপের পোস্টার বয়৷ এই দলে সেকেন্ড ইন কমান্ড দিল্লির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া জঙ্গপুরা আসনে হেরেছেন ৬০০ ভোটে৷ জেলে যাওয়া আর এক নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন পরাজিত হয়েছেন শকুর বস্তি আসনে৷
কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গড়লেও খোদ দিল্লির বুকে গত ১১ বছর বিরোধীদের রাজত্ব থেকে গিয়েছিল৷ আপের আগে বিধানসভা ছিল কংগ্রেসের হাতে৷ বিজেপির মদনলাল খুরানা, সাহেব সিং বর্মা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন গত শতকে৷ প্রায় তিন দশক পর দিল্লিতে ফুটল পদ্ম৷ বিজেপি ৪৮ আসন পেতে চলেছে, আম আদমি পার্টি ২২৷ যদিও প্রাপ্ত ভোটে বেশি ফারাক নেই৷ বিজেপি ৪৬ ও আপ ৪৪ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে৷ কংগ্রেসের প্রাপ্তি ৭ শতাংশের মতো ভোট৷
কে নতুন মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সেটা নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে বলে বিজেপি সূত্রের খবর৷ শনিবার রাত পৌনে আটটা নাগাদ বিজেপি কার্যালয়ে আসবেন নরেন্দ্র মোদী৷ রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের মতো চমক জাগিয়ে কোনো নতুন মুখকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় কি না, সেদিকে নজর রয়েছে৷ সাবেক বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরি হেরে গিয়েছেন৷ আর এক সাবেক সাংসদ প্রবেশ বর্মা কেজরিওয়ালকে হারিয়ে এখন জায়ান্ট কিলার৷ তিনি এগিয়ে রয়েছেন কুর্সির দৌড়ে৷
জয়ের ফ্যাক্টর
দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না হাজারের যে আন্দোলন, তার অন্যতম সৈনিক হিসেবে উঠে এসেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ গত দুই বছরে তিনি সবচেয়ে বেশি বিদ্ধ হয়েছেন এই দুর্নীতির প্রশ্নেই৷ আবগারি কেলেঙ্কারি মামলায় জেলে যেতে হয়েছে তাকে৷ তার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতার একই হাল হয়েছে৷
মুখ্যমন্ত্রীর আবাস নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি৷ প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতির টাকাতেই কি বিলাসবহুল বাসভবন গড়ে তুলেছেন আম আদমির নেতা? বিজেপি দুর্নীতিকে সামনে রেখে জোরালো প্রচার চালিয়েছিল৷ ফল প্রকাশের পর আন্না হাজারে বলেছেন, ‘‘ভোটের প্রার্থীকে কলঙ্কমুক্ত শুদ্ধ হতে হয়, তবেই তার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা জন্মায়৷ এ কথা বারবার বলেও বোঝানো যায়নি৷''
জনমোহিনী রাজনীতিতে মানুষের মন কেড়েছিলেন অরবিন্দ৷ এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে তার থেকেও বেশি সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি৷ বিনামূল্যে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ শুধু নয়, যুবকদের চাকরি থেকে নারীদের অ্যাকাউন্টে টাকা, সন্তানসম্ভবাকে অনুদানের মতো নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা৷ খেটে-খাওয়া দরিদ্র মানুষ, যারা মূলত আপের ভোটার, তাদের জন্য প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি৷ প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানসিকতার সঙ্গে জনকল্যাণের রসায়ন সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত করতে পেরেছে মোদী ব্রিগেড৷
এবারের ভোটে দিল্লির দূষণও যথেষ্ট আলোচনায় ছিল৷ এক্ষেত্রে আপ ব্যর্থ বলে প্রচার করেছে বিজেপি ও কংগ্রেস৷ দিল্লির ব্যাপক দূষণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যমুনার বেহাল দশা ভোটারদের একাংশকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷
ভোটের ঠিক আগে জাতীয় বাজেট বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে৷ দিল্লিতে ৬৭ শতাংশ মধ্যবিত্তের বাস৷ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও সেনাকর্মী মিলিয়ে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ৷ এবারের বাজেট এই অংশকে অনেকটাই খুশি করেছে৷ বিশেষত ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয় করমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত মাস্টারস্ট্রোক বলে মনে করা হচ্ছে৷
জোটের জলাঞ্জলি
রাজনৈতিক কৌশলেও আপ ও কংগ্রেসকে পিছনে ফেলেছে বিজেপি৷ নির্বাচনী ফলাফলের প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে না পারায় সুবিধা পেয়েছে পদ্ম শিবির৷ কংগ্রেস গত দুইবারের বিধানসভা ভোটে সেভাবে লড়াইতে ছিল না৷ এবার তারা ভোটের ময়দানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে আম আদমি পার্টির ভোটে ভাগ বসিয়েছে৷
কেজরিওয়াল প্রায় তিন হাজার ভোটে হেরেছেন৷ এই নয়াদিল্লি কেন্দ্রে কংগ্রেসের সন্দীপ দীক্ষিত এর থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন৷ একই কথা খাটে সিসোদিয়া, সৌরভ ভরদ্বাজ-সহ অন্যান্য নেতাদের ক্ষেত্রে৷ কালকাজি কেন্দ্রে এই কারণেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছিলেন দিল্লির বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অতিশী৷ সাড়ে তিন হাজারের অল্প ব্যবধানে জয় পেয়েছেন তিনি৷
বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হওয়ার প্রভাব দেখা গিয়েছে এমন আসনেও, যেখানে সংখ্যালঘুরা বিপুল সংখ্যায় রয়েছে৷ যেমন মুস্তাফাবাদ কেন্দ্রে ৩৫ শতাংশ মুসলমান৷ সেখানে বিজেপি প্রার্থী একটা সময়ে ৪০ হাজার ভোটে এগিয়েছিলেন৷ উল্টো দিকে বিজেপি ৬৮টি কেন্দ্রে লড়াই করেছে৷ বিহারি ও পূর্ব ভারতীয়দের ভোটের কথা ভেবে দুই আঞ্চলিক দল লোকজনশক্তি পার্টি ও জনতা দল ইউনাইটেডকে একটি করে আসন ছেড়ে দিয়েছিল তারা৷
দিল্লির নির্বাচন ইন্ডিয়া জোটের অস্তিত্বকে আরো একবার বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল৷ জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লা এক্স হ্যান্ডেলে এ কারণে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন৷ বলেছেন, ‘‘প্রাণ ভরে লড়াই করো একে অপরকে হারিয়ে দাও৷'' অথচ গত লোকসভা নির্বাচনে জোট বেঁধে দিল্লির সাতটি আসনে লড়েছিল আপ ও কংগ্রেস৷ ২০২৪ সালের সেই ভোটে একই ছবি দেখা গিয়েছিল পাশের রাজ্য পাঞ্জাবে৷
হারের পর কেজরিওয়াল বলেন, ‘‘আমরা এখানে গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করব৷ সমাজসেবা এবং মানুষের হিতার্থে কাজ চালিয়ে যাব৷ ক্ষমতা ভোগ করার জন্য আমরা রাজনীতিতে আসিনি৷''
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, ‘‘মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তারা পরিবর্তন চাইছিলেন৷ যারা জিতেছেন তাদের অভিনন্দন৷ আমরা যারা পরাজিত হয়েছি তাদের আরো পরিশ্রম করতে হবে৷''
ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মইদুল ইসলাম বলেন, ‘‘এ বারও গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের একটা অংশের ভোট আপ পেয়েছে৷ তবে পাঞ্জাবি, জাঠ ও পিছিয়ে থাকা মানুষদের একাংশ বিজেপিকে সমর্থন করেছে৷ তার উপর করছাড়ের বিষয়টা মধ্যবিত্তকে প্রভাবিত করেছে৷ এ ছাড়া তারা মনে করেছে, কেজরিওয়াল যে প্রকল্প চালাচ্ছেন তার জন্য অর্থের সংস্থান তিনি করতে পারবেন না যেহেতু কেন্দ্রে সরকার আপের হাতে নেই৷''
সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ইন্ডিয়া জোট আপাতত কোমায় চলে গিয়েছে, এটা বলা যেতে পারে৷ তবে ভবিষ্যতে আবার কোনো বড় রাজ্যের ভোটে বা জাতীয় নির্বাচনের সময়ে জোট দেখা যাবে৷ বিরোধীদের একজোট হতেই হবে, নইলে তারা নির্বাচনী ময়দানে বিজেপির সঙ্গে টক্কর দিতে পারবে না৷''
পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ টেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘দিল্লির ভোট বিজেপি জিততে চেয়েছে, তারা সেখানে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছে৷ কেজরিওয়ালকে জেলে পাঠিয়েছে৷ এ রাজ্যে তারা ভোটে জিততে চায় বলে মনে হয় না৷ তাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত বড় মাথারা বাইরে থাকেন, অনেকে জামিন পেয়ে যান৷ এজন্য আদালতে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়৷''