চাঁদাবাজির এমন ‘ডিজিটাল রূপ' নতুন হলেও, মূল রোগটি পুরোনো- ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রশ্রয়, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং বেছে বেছে আইনপ্রয়োগ।
চাঁদাবাজির অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, এই চক্র ভাঙা যাবে। জনগণের আশা ছিল, যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন করে এসেছে, তারা অন্তত অন্যায়-অনাচার থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন এবং অন্যদের এসব করতে দেবেন না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আজ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেভাবে প্রকাশ্যে দখল, চাঁদাবাজি, এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটছে, তা কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ব্যাধির রূপ নিয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, আসলে পরিবর্তনটা ঘটেছে কোথায়? ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে যখন চাঁদাবাজির প্রমাণ পাওয়া যায় তখন ধরে নেওয়া যায় সমস্যাটি ‘দলনিরপেক্ষ' এবং এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে গাঁথা।
সরকার পরিবর্তনের পর বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট অনেক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে এসেছে। দলীয় প্রভাব ও স্থানীয় আধিপত্য কাজে লাগিয়ে নতুন ক্ষমতার বলয়ে থাকা লোকজনই এখন সেই পুরোনো ‘খেলোয়াড়'দের জায়গা নিচ্ছেন। গুলশানে সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে যাদের ধরা হলো, তাদের মধ্যেই একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা। আবার এক বহিষ্কৃত ছাত্রনেতার বাসা থেকে পাওয়া গেছে আড়াই কোটি টাকার চেক। ফেসবুক লাইভে এসে অনেকেই জানাচ্ছেন, কীভাবে ‘জুলাই বিপ্লব' একপ্রকার মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। রাজধানীসহ দেশের বহু এলাকা এখন সিসি ক্যামেরার আওতায়। কিন্তু এসব ভিডিও ফুটেজে চাঁদাবাজির দৃশ্য থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকলেও তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপও চোখে পড়ছে না। ফলে, যারা চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন, তারা নানা ভয়-ভীতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন, বাকিরা ভয়ে চুপ থাকছেন।
রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা এখানেই। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা অনেক সময় নিজেরাই চাঁদাবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। দলের ভেতরে জবাবদিহি, শৃঙ্খলা বা স্বচ্ছতা না থাকলে এসব অপরাধ থামানো কঠিন। রাজনৈতিক অর্থায়নের অস্বচ্ছ পদ্ধতিও পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। নির্বাচনি খরচের চাপ সামাল দিতে গিয়ে রাজনীতি হয়ে উঠেছে পেশাভিত্তিক, লেনদেননির্ভর এবং দুর্বৃত্তায়িত। তবে ইতিবাচক দিক হলো, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করলেও দখল-চাঁদাবাজি নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারাও এখন মুখ খুলছেন।
বাংলাদেশে এই ধারা নতুন কিছু নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচক (CPI) প্রতিবছরই মনে করিয়ে দেয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আমরা। আগের মতো দুর্নীতিতে ‘চ্যাম্পিয়ন' না হলেও দুর্নীতির ধরন ও পরিসর পাল্টে যাচ্ছে, বিস্তার ঘটছে নতুন নতুন মাধ্যমে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটি বাংলাদেশের জন্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় নয়, জাতি হিসেবে মর্যাদারও প্রশ্ন।
এতসব দখল ও চাঁদাবাজি আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলেছে, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে বিকৃত এক মানসিকতা, যেখানে নিয়ম নয়, প্রভাব আর টাকাই মুখ্য। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কেবল বিরোধীদের টার্গেট না করে, প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। নইলে এই দখল-চাঁদাবাজির সংস্কৃতি আরো গভীরে গেঁথে যাবে এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলবে।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, চাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর আইন প্রয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সক্রিয়তা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তিন দিন সরকারবিহীন ছিল বাংলাদেশ। ওই তিন দিন দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুন-খারাবির ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সুযোগ পেলে আমরা কী করতে পারি। তাই চাঁদাবাজি হোক যতই ‘নতুন স্টাইলে', তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। নইলে এই সংস্কৃতি আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, আর ক্ষমতার পালাবদলে শুধু পাল্টাবে ‘চাঁদাবাজের নাম'।