তুর্কি টিভি সিরিজ: ধারাভাষ্য ও প্রোপাগান্ডা
২৭ জানুয়ারি ২০২৫ইস্তাম্বুলের আর্ট নুভো স্টাইলে তৈরি করা পেরা প্যালেস হোটেলের প্রশস্ত মার্বেল সিঁড়ির সামনে প্রায় ৬০ জন পুরুষ, মহিলা এবং শিশু দাঁড়িয়ে হোটেলের ১৩০ বছরের পুরাতন বিদ্যুৎচালিত লিফটটি দেখছেন। হোটেলের এক কর্মী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন যে তারা কোনো ট্যুরের জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। জানা গেল সুদূর স্পেন থেকে এসেছেন এই দর্শনার্থীরা।
এই কর্মী বলেন, "সিরিজটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে আমাদের এখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দর্শণার্থীরা এসেছেন।
তিনি যে সিরিজটির কথা বলছেন সেটি ‘মিডনাইট অ্যাট দ্য পেরা প্যালেস' নামের একটি তুর্কি টাইম-ট্রাভেল শো। চার্লস কিং-এর একই শিরোনামের বই থেকে অনুপ্রাণিত এই সিরিজটি। ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে নেটফ্লিক্সেও দেখা যাচ্ছে এই সিরিজটি। এরপর থেকে অনেকেই চিত্রগ্রহণের স্থানটি দেখতে এবং এর সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হোটেলটিতে আসছেন।
গল্পটি শুরু হয় এসরা নামে একজন সাংবাদিককে দিয়ে, যিনি ১৮৯৫ সালে চালু হওয়া এই গ্র্যান্ড হোটেলটি সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখতে চাচ্ছিলেন। চালু হওয়ার পর থেকে আগাথা ক্রিস্টি, আলফ্রেড হিচকক, গ্রেটা গার্বো এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো অতিথিদের স্বাগত জানিয়েছে এই হোটেল।
সিরিজটিতে দেখা যায়, হোটেল ম্যানেজার আহমেত গল্পের নায়িকা এসরাকে একটি গোপন কথা জানান। জাঁকজমকপূর্ণ ভবনের পুরনো ঘরের চাবিগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সময়-ভ্রমণকারার পোর্টাল। এসরা এই রুমে থেকে ১৯১৯ সালে চলে যান এবং একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি জানতে পারেন, এক ব্রিটিশ অফিসার তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে হত্যার পরিকল্পনা করছেন। এই পরিকল্পনা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করার চেষ্টা করেন এসরা। এভাবেই ইস্তানবুলকে নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক নাটকটি শুরু হয়।
১৭০টিরও বেশি দেশে বিক্রি হয়েছে তুর্কি সিরিজ
২০০০ সালের মাঝামাঝি থেকে তুর্কি টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তুর্কি রপ্তানিকারক পরিষদ এর মতে প্রতি বছর ১৭০টি দেশ নানা ধরনের তুর্কি সিরিজ কেনে। ২০২৩ সালে এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করেছে বলে জানা গেছে। গত বছর, এই আয় বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
তুর্কি বাণিজ্যমন্ত্রী ওমর বোলাত জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি দর্শক তুর্কি অনুষ্ঠান দেখেন।
সাফল্যের গল্প শুরু হয়েছিল মেলোড্রামা "গুমাস" ("সিলভার"), সোপ অপেরা "১০০১ নাইটস", ক্রাইম থ্রিলার "এজেল" এবং অ্যাকশন সিরিজ "ব্ল্যাক মানি লাভ" দিয়ে। তুরস্কের বাইরে প্রথম কাজাখস্তান এবং আজারবাইজানে সিরিজগুলো জনপ্রিয়তা পায়। তবে খুব শিগগিরইআরবভাষী দেশগুলো, লাতিন অ্যামেরিকা, বলকান, রাশিয়া এবং ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে এর সুনাম।
রোমান্স এবং সামাজিক ভাষ্য
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার পর্যবেক্ষণ সংস্থা- রেডিও এবং টেলিভিশন সুপ্রিম কাউন্সিল জানিয়েছে, দেশব্যাপী দর্শকরা প্রতিদিন প্রায় চার ঘণ্টা টেলিভিশন দেখেন, এবং বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় সম্প্রচারিত ধারাবাহিকগুলো। তুর্কি পরিবারের ৭০% এরও বেশি সদস্য নানা ধরনের স্ট্রিমিং পরিষেবার সাবস্ক্রিপশন গ্রহণ করেন।
প্রচার করা অনুষ্ঠানগুলোর তালিকায় রোমান্স এবং কমেডি থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক এবং সামাজিক নাটক পর্যন্ত রয়েছে। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান নিয়ে যত বেশি আলোচনা এবং সমালোচনা হবে, সেটির তুরস্কের বিচার ব্যবস্থার নজরে পড়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এই ধরনের অনুষ্ঠানের ভক্ত না হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখেননি। এমনকি এই ধরনের অনুষ্ঠানকে তিনি ইসলামবিরোধী এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলেও অভিহিত করেছেন। হামবুর্গের জিআইজিএ ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের একজন গবেষণা ফেলো হাক্কি তাস বলেছেন, এরদোয়ান সাধারণত এই ধরনের সমালোচনার পরেই জরিমানা আরোপের মাধ্যমে শাস্তি দেন।
ডিডাব্লিউ এর তুর্কি ডেস্ক জনপ্রিয় টিভি সিরিজ "কিজিল গনকালার" ("ক্রিমসন রোজবাডস") এর উপর আরোপিত ফি এবং নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এই সিরিজটিতে দেশটির ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গভীর বিভাজনে ইস্যুটি তুলে ধরা হয়েছিল। ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে এর সফল মুক্তির পর, সরকারপন্থি গোষ্ঠী এবং সংগঠনগুলো দাবি করে, সিরিজটি "আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ" লঙ্ঘন করেছে। অনুষ্ঠানটিতে দুই সপ্তাহের সম্প্রচার নিষেধাজ্ঞা এবং পৌনে তিন লাখ ইউরো জরিমানা করা হয়।
তুর্কি কর্তৃপক্ষ এখন সম্প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি শৈল্পিক ব্যবস্থাপনার ওপরও নজরদারি শুরু করেছে। প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অনেক এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
শুধু ব্যবসাই লক্ষ্য নয়
তুরস্কের সরকার টেলিভিশন সিরিজের নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। এইসব সিরিজ জনমতকে প্রভাবিত করতে এবং আদর্শিক মূল্যবোধ প্রচারণার প্ল্যাটফর্ম হিসাবেও কাজে লাগানো হয়।
তুরস্কে বেসরকারি প্রযোজনা ক্রমশ চাপের মুখে পড়লেও রাষ্ট্র নিজস্ব প্রযোজনায় প্রচুর বিনিয়োগ করছে। প্রতি বছর রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাবলিক ব্রডকাস্টার টিআরটি অসংখ্য ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করে। এগুলোতে তুর্কি জাতির ইতিহাস এবং মূল্যবোধকে রক্ষণশীল ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়। এর একটি উদাহরণ হল টেলিভিশন সিরিজ "রিসারেকশন: এরতুরুল"। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার বাবা ১৩ শতকের লর্ড এরতুরুলের জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই সিরিজ।
এরদোয়ানের সমালোচকদের নিন্দা বা তাদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্যও রাষ্ট্রীয় নানা প্রযোজনাকে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আট বছর ধরে কারাবন্দী উদ্যোক্তা এবং মানবাধিকার কর্মী ওসমান কাভালাকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে দেখিয়েছে টিআরটি প্রযোজিত "মেটামোরফোজ"।
সরকারের লক্ষ্য কী?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাক্কি তাস মনে করেন যে তুর্কি সরকার তুর্কি সমাজের উপর এমন একটি জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যা এরদোয়ানের ইসলামপন্থি রক্ষণশীল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এর মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেসব ধারাবাহিক নাটক একেপি এর মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা হয় এবং চাপ প্রয়োগ করা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই অনুষ্ঠানগুলো সামাজিক নানা ইস্যুতে আলোচনার প্ল্যাটফরম হয়ে উঠেছে।
তাস বিশ্বাস করেন যে এই অনুষ্ঠানগুলোর চরিত্র এবং প্লটগুলোতে প্রায়ই লুকানো বার্তা থাকে। তার বিশ্লেষণ, গত বছরের স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর উত্থানের পর এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এলমাস টোপকু, পেলিন উ্যংকার/এডিকে