টাটাকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশের পর সিঙ্গুর কী বলছে?
আবার সংবাদ শিরোনামে সিঙ্গুর। সম্প্রতি আদালত টাটাকে বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। তারপর কী বলছে সিঙ্গুর?
আদালতের নির্দেশ
টাটা মোটর্সকে ৭৬৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পোন্নয়ন নিগমকে। সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা বন্ধের প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের সালিশি আদালত (আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল) এই নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া তাদের সুদও দিতে হবে। সবমিলিয়ে ক্ষতিপূরণের অংকটা বিশাল।
টাটার কারখানা
২০০৬ সালে বাম সরকার টাটাকে সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি তৈরির জন্য জমি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই মতো রাজ্যের শিল্প উন্নয়ন নিগমের সঙ্গে টাটার চুক্তি হয়। টাটার কারখানার জন্য সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ ঘিরে কৃষকরা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এখন কী অবস্থা
সিঙ্গুরের বেরাবেড়ি, খাসেরভেড়ি, সিঙেরভেড়ি, বাজেমেলিয়া এবং গোপাল নগরের মোট পাঁচটি মৌজার ৯৯৭ একর জমি চিহ্নিত করে অধিগ্রহণ করা হয়। সেই জমি ঘেরা শুরু হতেই আন্দোলন শুরু হয়। বর্তমানে জমি ঘেরার সেই পাঁচিলের আবশিষ্টাংশটুকু পড়ে আছে কেবল।
লাগাতার আন্দোলন ও প্রতিবাদমঞ্চ
অনিচ্ছুক কৃষকেরা দাবি করেন, তাঁদের উর্বর জমি এ ভাবে জোর করে নিয়ে নেয়া যাবে না। রাজ্যের তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুরের কৃষকেরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যান। এই হাইওয়ের ধারেই তৈরি হয়েছিল ২১টি প্রতিবাদ মঞ্চ।
বিভক্ত কৃষকরা
কৃষকদের একাংশ চেয়েছিল, সিঙ্গুরের জমিতে শিল্প হোক, আবার কিথু কৃষকেরা জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েেছিলেন। গড়ে ওঠে সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটি। আন্দোলন তীব্র হলে প্রায় ৮০ শতাংশ কারখানা সম্পূর্ণ হওয়ার পরেও টাটারা বিদায় নেয়। জমি আন্দোলনের অন্যতম নেতা বেচারাম মান্না এখন রাজ্যের মন্ত্রী। সালিশি আদালতের রায় নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। উপরের ছবিতে বেচারাম মান্না।
ফেরত পাওয়া জমির যা অবস্থা
২০১৬ সালে ৩১ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সিঙ্গুরের সমস্ত কৃষক জমি ফেরত পান। কিন্তু, জমি চাষযোগ্য করে ফিরিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ জমি চাষাযোগ্য হয়নি বলে অভিযোগ কৃষকের একাংশের। সারা মাঠ জুড়ে এখন ঘাসের জঙ্গল ।
এখনো কারখানা না হওয়ার ক্ষোভ
কারখানা হওয়ার পক্ষে থাকা এক ‘ইচ্ছুক কৃষক’ ঋত্বিক দাসের গলায় একরাশ অভিমান। বললেন, ''কারখানা হলে এই অঞ্চলের ভোল বদলে যেত। আজ জমি ফেরত পেয়েও কী হয়েছে? এ জমি আর চাষের যোগ্য নেই। এক বিঘা জমি ঠিক করতে গেলে দশটা কোদাল ভেঙে যাবে।''
অন্য মতও আছে
জমি না দিতে চাওয়া 'অনিচ্ছুক কৃষক’ প্রসেনজিৎ দাস আজও বিশ্বাস করেন টাটার কারখান হলে ক্ষতিই হত। ''জমি থাকলে তাতে চাষ করে পেটের ভাতটুকু জোগানো যায়, কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কে খেতে দেবে?'' প্রশ্ন করে প্রসেনজিৎ।
সরকারি ভাতা নিয়ে
বর্তমানে যদিও জমির কিছু কিছু অংশে চাষবাস হচ্ছে। কেউ বলছেন পাঁচ শতাংশ, কেউ বলছেন চল্লিশ। চলছে চাপানউতোর। যারা জমি দিয়েছিলেন তারা সরকারের থেকে ভাতা পান। চাল আর দুহাজার টাকা মাসে। সেই ভাতা পাওয়া নিয়েও রয়েছে অভিযোগ।
কারখানার জায়গায়
জমি লাগোয়া এই কারখানাটিও অধিগৃহীত হয়েছিল সেইসময়ে। টাটারা চলে গিয়েছে, তাদের কারখানার চিহ্নমাত্রও নেই আজ, তবু আইনি গেরোয় ফেঁসে রয়েছে এই শান্তি সিরামিকের কারখানার অংশ। এখন এই কারখানার শেড পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গাড়ির গ্যারেজ।
মতও বদলেছে কিছু মানুষের
স্থানীয় মানুষের অনেকে, আগে বিরোধিতা করলেও আজ মনে করেন কারখানা হলে ভাল হত। কৃষ্ণ সাহানা বললেন, টাটারা ফিরে যাওয়ার পর প্রভাবশালীদের মদতে ওই কারখানা লুটেপুটে খেয়েছে কিছু স্থানীয় মানুষ। সব খুলে খুলে বিক্রি করেছে। ডিনামাইট দিয়ে ফাটানো হয়েছে। সেই আওয়াজে তার বাড়িতেও ফাটল দেখা দিয়েছিল সেইসময়। তিনি বলেন, “তখন যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কড়া হাতে এই আন্দোলন দমন করতে পারতেন তাহলে আজ সিঙ্গুরের চেহারা অন্য হত।
কথা বললেন না তাপসীর পরিবার
সিঙ্গুরের সঙ্গে তাপসী মালিকের নামও জড়িয়ে আছে। তাপসীকে ধর্ষণ করে হত্য়া করা হয় বলে অভিযোগ। বর্তমান পরিস্থিতি দেখতে ডিডাব্লিউ তাপসী মালিকের বাড়িতেও গিয়েছিল। তার পরিবার কথা বলতে চাননি।
সিঙ্গুরের অবস্থা
এই হলো সিঙ্গুরের অবস্থা। উপরের ছবি থেকে যা স্পষ্ট। উর্বরা জমি আর নেই। গাড়ির কারখানাও হয়নি। সব হারিয়ে সিঙ্গুর এখন কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে বেঁচে আছে। কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে জমি নেয়ার ক্ষোভ। কারখানা না হওয়ার কষ্ট। এই অবস্থা থেকে সিঙ্গুর আর বেরিয়ে আসতে পারছে না।