জার্মান নির্বাচন: অভিবাসন নিয়ে ইশতেহারে কী জানালো এফডিপি?
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সাধারণভাবে, এফডিপি-কে ব্যবসাবান্ধব দল হিসেবে দেখা হয়৷ বিশেষত উদ্যোক্তা, কোম্পানির কর্তাব্যক্তি এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক নেতাদের ভোট নিজেদের দিকে টানতে চান তারা৷ মুক্ত ও উদারপন্থি নীতির কারণে বেশিরভাগ বিষয়ে মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে দলটির৷ ফলে অভিবাসন ইস্যুতেও তাদের মনোভাব উদার হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করেন অনেকে৷
দলটি নিজেদেরকে মধ্যপন্থি দাবি করলেও তাদের কিছু কিছু অবস্থান ডানপন্থিদের মতোই৷ আসন্ন নির্বাচন ঘিরে হওয়া বিভিন্ন জনমত জরিপে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে রক্ষণশীল দল সিডিইউ/সিএসইউ৷ ধারণা করা হচ্ছে, এফডিপির সমর্থনও তাদের দিকেই যাবে৷
তবে, এফডিপির জনপ্রিয়তা এখন পড়তির দিকে৷ কারণ জার্মানির বিদায়ী জোট সরকারের একটি অংশ তারা৷ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এবং গ্রিন পার্টির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় রয়েছে এফডিপি৷ কিন্তু জোটের ভাঙনের কারণে সাধারণ নির্বাচন এগিয়েছে সাত মাস৷ ফলে, আগামী নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোট পেয়ে জার্মান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে যাওয়াটাও তাদের জন্য কঠিন হতে পারে৷
এমনকি, দলটি যদি পাঁচ শতাংশ ভোটের সীমা অতিক্রম করতেও পারে সরকার গঠনে সিডিইউ/সিএসইউ-এর একক সহযোগী হওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ কারণ, দুটি দলের মোট ভোট পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে৷
বাঁচো এবং বাঁচতে দাও?
করের বোঝা কমানো এফডিপির শীর্ষ এজেন্ডার একটি৷ জনজীবনে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করতে চায় না দলটি৷ মোটা দাগে বলতে গেলে, দলটি অনেক ইস্যুতে ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও' পদ্ধতি গ্রহণ করে৷
২০২৫ সালের নির্বাচনে, দলটি তার ইশতেহারে থিম হিসাবে বলে হয়েছে, ‘‘সবকিছুই পরিবর্তনযোগ্য''৷
৫১ পৃষ্ঠার ইশতেহারের শুরুতে বলা হয়েছে, ‘‘আমরা সবাই এটি বুঝতে পারি: কোনো কিছুই আগের মতো থাকতে পারে না৷''
ইশতেহারের প্রথম অনুচ্ছেদের মাঝামাঝিতে বলা হয়েছে, দেশের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের সুফলের মধ্যে রয়েছে ‘‘অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পাচ্ছে জার্মানি৷'' শুরুতে অভিবাসন ইস্যুকে সামনে আনার মধ্য দিয়ে মধ্যপন্থি দাবি করা দলটির ডানদিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত দেয়৷ সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব দলের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা গেছে৷
শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান
ইশতেহারে প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা হলো শিক্ষা৷ তারা ‘নাগরিকদের জন্য বিশ্বের সেরা শিক্ষা' নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷
অভিবাসী শিশুদের জার্মান ভাষায় স্কুলে পড়াশোনা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত সহায়তা দিতে চায় দলটি৷ দক্ষ কর্মীদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রির স্বীকৃতির প্রক্রিয়াটিও সহজতর করার কথা জানানো হয়েছে৷
গবেষণা করতে আসা উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন অভিবাসীদের কাছে জার্মানিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে চায় এফডিপি৷ উদ্ভাবনের জন্য জার্মানিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গন্তব্যে পরিণত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে তারা৷
ফ্রি লিবারেলরা শিক্ষা অনুচ্ছেদে বিদেশিদের ভূমিকার কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছে৷ কিন্তু জার্মানিতে কাজ করতে আসা অভিবাসীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং বেশিসংখ্যক অভিবাসী কর্মীদের আকৃষ্ট করতে কোনো বাস্তব নীতিমালা প্রস্তাব করেনি৷
‘‘আমাদের দেশের শ্রমবাজারে অভিবাসন জরুরি প্রয়োজনীয়'' বলে ইশতেহারে উল্লেখ করেছে এফডিপি৷ কিন্তু কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রস্তাবনায় দেখা গেছে কর কমানো, পাবলিক পেনশন তহবিলের বেসরকারিকরণ, উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা, অর্থনীতি সংস্কার এবং নিয়ম-কানুন সহজ করার দিকে দলটি মনোযোগ দিয়েছে বেশি৷
এফডিপির তুলনায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলো আরো পরিষ্কারভাবে জার্মানিকে দক্ষ অভিবাসী কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় করার দিকটিতে গুরুত্ব দিয়েছে৷
অভিবাসনের মাধ্যমে শ্রম ঘাটতি মোকাবিলার প্রসঙ্গে এফডিপি ইশতেহারে জানিয়েছে, এ সংক্রান্ত আইন সহজীকরণ, আর্থিক প্রণোদনা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা হবে৷
তবে, ইশতেহারে দলটি আরো প্রস্তাব করেছে, সব আশ্রয়প্রার্থীর শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ থাকা উচিত৷ কিন্তু বর্তমান নিয়মে, সুরক্ষা মর্যাদার ভিত্তিতে এই সুযোগটি দেয়া হয়৷
আগমন সীমিত করার নতুন কৌশল
অনিয়মিত অভিবাসী এবং আশ্রয় ইস্যুতে দলটি বলছে, ‘‘আশ্রয়প্রার্থীরা যদি নিরাপদ থাকেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই নিশ্চিত করা যায়, তবে তৃতীয় দেশগুলোতেও আশ্রয় প্রক্রিয়া করা উচিত৷''
এমনকি, অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধে জার্মান সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে আলোচিত পাইলট প্রকল্পেও সমর্থন জানিয়েছে দলটি৷
দলটি বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অভিবাসন চুক্তিগুলোর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থীদের মূল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, যাতে তারা অভিবাসীদের ফিরিয়ে নেয়৷ প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে দ্বিপাক্ষিক অভিবাসন চুক্তির দিকেও বিশেষ নজর দেয়ার পক্ষে এফডিপি৷
যারা পূর্ণ সুরক্ষা নয় বরং সহায়ক সুরক্ষা পেয়েছেন, তাদের পারবিরাকি পুনর্মিলন স্থগিত করার পক্ষেও নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে দলটি৷
যারা থাকবেন, যাদের যেতে হবে
যারা দক্ষকর্মী হিসাবে জার্মানিতে আসেন, আর যারা সুরক্ষার জন্য আসেন, তাদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রাখতে চায় মুক্ত উদারপন্থিরা৷ দলটি বলেছে, তারা অভিবাসন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ করতে চায়৷ বেশ জোর দিয়ে তারা জানিয়েছে, অনিয়মিত অভিবাসীদের কারণে চাপের মুখে রয়েছে জার্মান আশ্রয় ব্যবস্থা৷ বিশেষ করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে এই চাপ সইতে হচ্ছে বেশি৷ এ কারণে সমাজে অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়াও ব্যহত হচ্ছে৷
ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘‘অভিবাসনের ক্ষেত্রে দ্রুত পদ্ধতি এবং স্পষ্ট সিদ্ধান্ত প্রয়োজন৷ আমরা একটি নতুন অভিবাসন নীতি চাই, যা আরো নিয়ন্ত্রিত এবং সুশৃঙ্খল৷ যারা এখানে কাজ করেন এবং আমাদের মূল্যবোধ অনুসারে জীবনযাপন করেন তাদের জন্য এটি সহজ হওয়া উচিত৷ আর যারা আমাদের সামাজিক সুরক্ষাকে বিপন্ন করতে চায়, তাদের জন্য এটি আরো কঠিন হবে৷''
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘আমরা শ্রমবাজারে অভিবাসন চাই, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় নয়৷ বাস্তবতার নিরিখেই আমরা আমাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করতে চাই৷ অভিবাসনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কেবল টেকসই অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমেই সম্ভব৷''
দলটি আরো জানিয়েছে, সমাজে অন্তর্ভুক্তিতে সফল ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দিতে আপত্তি নেই তাদের৷ তবে, নাগরিকত্ব অর্জন করতে হলে অবশ্যই জীবিকার সংস্থান থাকতে হবে৷
অসহিষ্ণুতায় নেই সহনশীলতা
বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রতি তাদের শূন্য-সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে এফডিপি৷ তারা জানিয়েছে, ‘‘আমরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করব৷'' বিদেশিদের মাধ্যেম সংগঠিত বা আমদানি করা অপরাধ বরদাস্ত করবে না তারা৷ অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও গুরুত্ব দিয়েছে মুক্ত উদারপন্থি রাজনৈতিক দলটি৷
অভিবাসন ইস্যুতে দলটি বলেছে, অপরাধে জড়িত বা সমাজের জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তিদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে৷
সমাজে ইসলাম চর্চা
সব বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসাবে ধর্মীয় স্বাধীনতাতেও বিশ্বাস করে এফডিপি৷ তারা জোর দিয়ে বলেছে, ‘‘ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের সমতা এবং বৈচিত্র্য, মৌলিক অধিকার এবং ধর্মানুসারীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতিকে স্বীকৃতি দেয়া হবে৷''
ইসলাম প্রসঙ্গে দলটির ভাষ্য হলো, ‘‘আমরা ইসলামি সম্প্রদায়গুলোর সমালোচনার স্বাধীনতা চাই৷ আমাদের স্পষ্ট করতে হবে কোন চর্চা জার্মান রাষ্ট্রের অংশীদার হতে পারে এবং কোনটি হতে পারে না৷ যারা ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা করে না, তারা এই দেশে ধর্মীয় নীতিতে অংশীদার হতে পারে না৷''
দলটি আরো বলেছে, ‘‘জার্মান সমাজে মুসলিম উগ্রপন্থিরা সামাজিক বিভাজন, সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করছে৷ বিশেষ করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলামপন্থি উগ্রতা বেড়েছে৷ ফৌজদারি আইনের পাশাপাশি, অভিবাসন আইনের অধীনে এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷''
জের্টান জ্যান্ডারসন/টিএম
প্রথম প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ইনফোমাইগ্রেন্টস
অভিবাসী বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস তিনটি প্রধান ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্বে একটি যৌথ প্লাটফর্ম৷ প্লাটফর্মটিতে রয়েছে জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স মিডিয়া মোন্দ, এবং ইটালিয়ান সংবাদ সংস্থা আনসা৷ এই প্রকল্পের সহ-অর্থায়নে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷