জলবায়ু পরিবর্তনের ঋণটা সুদমুক্ত হওয়া উচিত: ড. আইনুন নিশাত
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ডয়চে ভেলের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক সব বিষয়েই কথা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত।
ডয়চে ভেলে : অর্থ দিয়ে কি আসলে জলবায়ু সমস্যার সমাধান সম্ভব?
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত : অবশ্যই। অর্থ একটা বড় এলিমেন্ট। গ্রিণহাউজ গ্যাস বাড়ছে, সেটা কমানোর জন্য এনার্জি এফিসিয়েন্সি প্রয়োজন। পুরনো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে পরিমার্জন করে এনার্জি এফিসিয়েন্সি অর্জন করা উচিত। এর সঙ্গে আছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের অভিযোজন প্রক্রিয়ায় ১৪টি বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কথা বলা হয়েছে। ১১টা জায়গাতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। শহরগুলো খারাপ অবস্থায় আছে, উপকূল খারাপ অবস্থায় আছে। এর জন্য আমাদের প্রচুর টাকা লাগবে। কাজেই যখন বৈশ্বিক আইনটা তৈরি হয় ১৯৯২ সালে, তখনই ৪টি ব্লকে ভাগ করা হয়। অর্থ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা সম্ভব না। এখন এটার জন্য তো আমরা দায়ী না, কিন্তু এটা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের মতো গরিবদেশগুলোই ভুগবে। ফলে তখন যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল অ্যানেক্স-২-এ যে ২৩টি দেশ আছে উন্নত এবং অ্যানেক্স-১-এও ১৬-১৭টি দেশ আছে, তারা অর্থায়ন করবে। কথাটা হচ্ছে, বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য যে অর্থটা খরচ হচ্ছে, সেটা অনুদান হিসেবে তাদের দিতে হবে। আমাদের বৈশ্বিক দাবিটা হচ্ছে, এই টাকাটা তারা অনুদান হিসেবে দেবে। কিন্তু এখানেও তারা অল্প অল্প করে ইন্টারেস্ট ঢুকাচ্ছে। দেখেন, মেগা প্রকল্প যতগুলো হয়েছে, একটা-দুটো ছাড়া বাকিগুলোর কতটা প্রয়োজন? অথবা প্রয়োজন থাকলেও সেটা কি সঠিক ডিজাইনে করা হয়েছে? উত্তর হচ্ছে- না। কেন হয়নি? যেমন ধরেন পানি সংক্রান্ত কিছু হলে নেদারল্যান্ডস মাতুব্বরি করে। যোগাযোগ সংক্রান্ত কিছু হলে বিশ্বব্যাংক তাতে মাতুব্বরি করে। এয়ারপোর্ট নির্মাণ হবে তার পুরো ঋণটা এসেছে জাপানের কাছ থেকে। এখন জাপান সরকারের প্রতিনিধি এটা তদারক করে, জাপানি বিশেষজ্ঞ এটা গাইড করে এবং জাপানি কন্টাক্টার এটার কাজ করে। অর্থাৎ, তিনজনই এক দলের। ফলে ঋণটা যারা করে, তারা অনেক উল্লসিত হয়- তাদের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। কিন্তু কাজটা যদি প্রকৃত খরচের তিনগুন বেশি খরচ দিয়ে করা হয়, সেটা তো সাস্টেইনেবল হবে না। ঋণের পুরো প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ব্যবসা করে। এই ব্যবসা তারা করে চড়া দামে। যেহেতু দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র নেই, জবাবদিহিতা নেই, টাকা পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সত্যিকারে যদি জবাবদিহিতা থাকতো, দুর্নীতি না থাকতো, তাহলে সঠিক খরচে প্রকল্পটা করা যেতো। তারা অর্থ দিয়ে, সুদ নিয়ে শোষণ করছে। তাদের বিশেষজ্ঞ এনে তাদের মতো করে প্রজেক্টটা করার কারণে যারা ঋণ নিচ্ছে, তাদের প্রকৃত উপকারটা হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তো মূলত দায়ী কার্বন নিঃসরণ। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেটা বলা হচ্ছে, যে দেশ সেই দেশই পরিকল্পনা করবে। কারণ, সে বোঝে তার কী প্রয়োজন। আমাদের দেশে যতগুলো পরিকল্পনা দরকার, সেগুলো আছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, আমরা আপডেট করছি। কাজেই আমাদের কী করতে হবে, সেটা জানা আছে। কিন্তু অর্থের অভাবে এটা আমরা ঠিকমতো করতে পারছি না। অর্থায়নের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটা আছে, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করাটাও কঠিন কাজ। এই কারণে বিশ্বজুড়ে এখন যে শ্লোগানটা হচ্ছে, আমার যে ঋণ আছে, তার অব্যবস্থাপনার জন্য তোমারও দায় আছে। যেন এর কিছু অংশ প্রকৃতি সংরক্ষনের জন্য ব্যবহার করা হয়। আমরা যেন তাদের বলতে পারি, আমরা যে ঋণ শোধ করি, এর মধ্যে যে সুদটা আছে সেটা তোমরা নিও না, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য দাও। এইভাবে ইউএসএআইডির একটা প্রকল্প আছে, যেটার নাম হচ্ছে আরণ্য ফাউন্ডেশন। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ নিয়েছে, সেটা এখন শোধ করছে। এখানে যে সুদটা, সেটা একটা ফাউন্ডেশনে রাখা আছে। সেটা দিয়ে বাংলাদেশে প্রকৃতি সংরক্ষনের কাজ করা হয়। ফলে আইডিয়াটা হচ্ছে, এই ঋণগুলোকে অন্যভাবে দেখতে হবে। আমাকে যখন চাপ দেওয়া হয় ‘ঋণ শোধ করো', তখন আমার বাজেটের উপর চাপ পড়ে। এটার পরিবর্তন অনুন্নত দেশগুলো চাচ্ছে। কিন্তু যারা টাকাটা লগ্নি করেছে, তারা তো ব্যবসার জন্য করেছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্র টু রাষ্ট্র যে ঋণ- সেটা খারাপ। এতে শর্তগুলো খারাপ থাকে। আমাদের আমলা, মন্ত্রীরা টাকা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এই টাকা জাতির জন্য কতটা মঙ্গল বয়ে আনবে, সেটা তারা চিন্তা করে না।
ঋণ সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রত্যাহার এবং ঔপনিবেশিক ঋণ কাঠামো থেকে মুক্তির কোনো পথ কি আপনি দেখেন?
আমি কোনো পথ দেখি না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য আমার ঋণ লাগবে। আমার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঋণ লাগবে। আমার রাস্তা লাগবে, অবকাঠামো বানাতে হবে। কৃষিতে বিনিয়োগ লাগবে। যে কারণে ঋণ নিতে হচ্ছে, সেই কারণটা যদি উন্নত বিশ্বের কারণে হয়ে থাকে, যেমন- জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়, ফলে এর ঋণটা সুদমুক্ত হওয়া উচিত। ইতিমধ্যে আমরা যে ঋণ নিয়েছি, তাতে দেশ কতটা উপকৃত হয়েছে, সেটা বের করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা- জবাবদিহিতা নেই। অর্থ ব্যবস্থাপনাতে জবাবদিহিতা থাকলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতে পরতো। খেয়াল রাখা উচিত ঋণের ভারে যেন আমরা জর্জরিত না হই। শ্রীলংকার ঋণের কথা আমরা জানি। কারণ, তারা অপরিমিত পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল। আমাদের অর্থ উপদেষ্টা বারবার বলছেন, ঋন শোধ করতে গিয়ে আমাদের বাজেটের একটা বড় অংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে। ঋণ নেওয়ার আগে সত্যিকারের প্রজেক্টটা প্রয়োজন কিনা সেটা দেখা উচিত।
সম্প্রতি একশনএইড ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উন্নয়নের নামে' প্রায় ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি ঋণের ফাঁদে জর্জরিত হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ ধনী ও দূষণকারী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা। এটা কি শুধুই অঙ্গীকার নাকি এই অর্থ পাওয়া যায়?
পাওনার কথা যেটা বলছে, সেটা কিভাবে হিসাব হয়েছে, আমার জানা নেই। তবে বিশ্বজুড়ে কতগুলো হিসাব আছে। উন্নত দেশ প্রতি বছর তাদের জিডিপির পয়েন্ট ৭ শতাংশ আর্থিক অনুদান হিসেবে দেবে। তারা দেয় না, সেটা অন্য কথা। এটা হয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কতটা প্রভাব- তার হিসাব। আমার কথা হচ্ছে, ঋণ যত কম নেওয়া যায়, তত ভালো। আর ঋণ যেটা নেওয়া হবে, সেটার জন্য সঠিক ব্যবহার হয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন। আমি টাকা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বো, এটা তো ঠিক না। আমাদের দেশে কথা আছে, ‘ঋণ করিয়া ঘি খাইয়ো না।' এখানে তো ঋণ করে ঘি খাওয়ার অভ্যাস বেশি। আমি বিদেশিদের দায়ী করার পরিবর্তে দেশের নীতিনির্ধারকদের দায়ী করবো। তুমি অযথা ঋণ নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে কেন বিপদে ফেলছো।
২০২৪ সালে ৫৪টি নিম্ন আয়ের দেশ বিদেশি ঋণের ফাঁদে জর্জরিত ছিল। দেশগুলো জাতীয় উন্নয়ন বিসর্জনের বিনিময়ে ধনী দেশগুলোকে ১৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। ধনী দেশ, বেসরকারি ঋণদাতা এবং বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জলবায়ু কর্মসূচিসহ অপরিহার্য সরকারি সেবাসমূহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের মানুষ। বাস্তবতা কি এমন?
অবশ্যই এমন। আমার ধারণা, আমাদের দেশে কয়েকদিনের মধ্যে একটা রিভাইজ বাজেট তৈরি হবে। আবার জুন মাসে পরবর্তী অর্থবছরের জন্য আরেকটা বাজেট দেওয়া হবে। যে কেউ উন্নয়ন বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখবেন, এক চতুর্থাংশ বা তৃতীয়াংশ টাকা ঋন শোধ করতে বা সুদ শোধ করতে লাগে। আগের ঋণ তো শোধ করতে হবে। আমি মনে করি, উন্নত বিশ্বের দিকে আঙ্গুল যতটা দেখানো প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় সরকারগুলোর উপর।
বিদেশি ঋণের কঠিন সংকটের বিষয়টি তুলে ধরে অ্যাকশনএইড বলছে, বিদেশি ঋণ প্রত্যাহার এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার কি আসলেই পাওয়া যাবে?
এগুলো শ্লোগানধর্মী কথাবার্তা। যারা অ্যাক্টিভিস্ট তাদের কথাবার্তা। আবারও বলছি, আমার ঋণ প্রয়োজন আছে। আমাদের মতো দেশগুলোর প্রয়োজন স্বল্প সুদে ঋণ। আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য যেটা দেওয়া হবে, সেটা যেন অনুদান হয়। এখন আমরা যদি অবিবেচকের মতো ঋণ নেই, তাহলে তো হবে না। যেমন ধরেন, কর্ণফুলী টানেল। এটার তো তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রত্যেকটা প্রকেক্টে যে অপচয় হয়, যেমন ধরেন, আমরা বাজেট করি একশ' কোটি টাকা, শেষ করি তিনশ' কোটি টাকায়। এগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণের যে অর্থ পাওয়া যায়, সেটা কি দুর্নীতিমুক্তভাবে ব্যয় হয়? এটা কি সঠিকভাবে দেখভাল করা হয়? এর জবাবদিহিতাই বা কার কাছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমাকে হাসতে হবে। ক্ষতিপূরণের টাকা কে দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে? কবে থেকে দিচ্ছে? কে নিচ্ছে? এগুলো সব তাত্ত্বিক কথাবার্তা। গত তিন- চার বছর আগে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ' বলে একটা কনসেপ্ট দাঁড়িয়েছে। এটা এখনো কার্যকর হয়নি। দুবাইয়ের নেতৃত্বে কিছু দাতা দেশ মিলে একটা ফান্ড করেছে। ওটা থেকে এক পয়সা এখনো আসেনি। কবে আসবে তা-ও জানি না। কোন ধরনের প্রকেক্টের জন্য আসবে তা-ও জানি না। এগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিষ্ঠানের প্রচারকাজ।