জয়েন্টের ফল প্রকাশে বিলম্ব, পড়ুয়ারা যাচ্ছেন ভিন রাজ্যে
২৭ জুন ২০২৫গত ২৭ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড পরীক্ষা নেয়। এখন আর ডাক্তারি পড়ার জন্য এই পরীক্ষা নেয়া হয় না। ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি ও আর্কিটেকচার নিয়ে যারা পড়াশোনা করতে চান, তারা এই পরীক্ষায় বসেন।
ফল প্রকাশে দেরি
প্রতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ও তার ফল প্রকাশের মধ্যবর্তী কোনো একটা সময় জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেয়া হয়। সেই হিসেবে এপ্রিল মাসে এবারও পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্যবার যে সময়ে ফল প্রকাশিত হয়ে যায়, সেই সময় পার হয়ে গেলেও জয়েন্টের ফল নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না।
গত তিন বছরে নির্ধারিত সময়ে ফল বেরিয়েছিল। ২০২২ সালে ৩০ এপ্রিল পরীক্ষা নেয়া হয়। ফল বেরিয়েছিল ১৭ জুন। তার পরের বছরে একই তারিখে পরীক্ষা হয়। ফল অনেক আগে বেরোয়, ২৬ মে। গত বছর ২৮ এপ্রিল পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। ফল বেরিয়েছিল ৬ জুন। এই পরম্পরা অনুযায়ী জুনের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে ফল বেরিয়ে যাওয়ার কথা।
ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সর্বভারতীয় প্রবেশিকা জেইই মেন্স ও জেইই অ্যাডভান্স-এর ফল বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্টের ফল কবে বেরোবে? তা নিয়ে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বোর্ডের কাছ থেকে। যথাসময়ে ফল প্রকাশের কথা জানানোর আশ্বাস দিয়েছে তারা।
বিপাকে পরীক্ষার্থীরা
অনেক মেধাবী পড়ুয়া উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে সঙ্গে জয়েন্টের প্রস্তুতি নেন। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নের কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। এই পড়ুয়াদের লক্ষ্য থাকে মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা। পশ্চিমবঙ্গে যারা জয়েন্ট পরীক্ষা দেন, তাদের প্রথম পছন্দ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এ বছর ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় পরীক্ষার্থীরা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন।
সর্বভারতীয় প্রবেশিকার ফল প্রকাশের পরে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্টের ফল প্রকাশের এটাই সম্ভাব্য সময়, যখন সর্বত্র ফল বেরোতে থাকে। বেসরকারি কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে, কী হবে এই পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ?
এই কথা মাথায় রেখে অনেক পরীক্ষার্থী ইতিমধ্যে বেসরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই যাদবপুর বা সরকার পোষিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার খরচ অনেক বেশি। যে অভিভাবকদের সামর্থ্য আছে, তারা ইতিমধ্যেই অন্যান্য রাজ্যে ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছেন। কিন্তু অভাবী ঘরের মেধাবী পড়ুয়ার আটকে যাচ্ছেন।
কিন্তু পরীক্ষার ফল বেরোলে যত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতেন, তার তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম ভর্তির সংখ্যা। এর ফলে আসন ফাঁকা পড়ে থাকছে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও।
এই কলেজগুলোর সংগঠন আপাই–এর সভাপতি, সর্দার তরণজিৎ সিং জানিয়েছেন, একাধিক বার জয়েন্ট বোর্ড ও শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। কিন্তু এই আলোচনায় সমস্যা মেটেনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা আর নতুন ছাত্র-ছাত্রী পাব বলে মনে হচ্ছে না। যদিও বা কিছু পাওয়া যায়, অনেক সিট ফাঁকা থেকে যাবে, এমন আশঙ্কা থাকছে। ছাত্র-ছাত্রীরা ফলের জন্য কতদন আর অপেক্ষা করবেন।"
পর্যবেক্ষক ও অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "ভর্তির সমস্যা সব জায়গাতেই থাকবে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা এতে বাড়বে। এটা সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে ভালো নয়। বেসরকারি কলেজে পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য সবার থাকে না। এই ধরনের ঘটনা শিক্ষার বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করবে। নয়া ওবিসি বিজ্ঞপ্তিতে অনেক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যথাযথ সমীক্ষা ছাড়া। তাই আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে।"
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, "জয়েন্ট এন্ট্রান্সে মেধা তালিকায় উপরের দিকে র্যাঙ্ক করা পড়ুয়ারা যাদবপুরে ভর্তি হয়ে থাকেন। তারা সর্বভারতীয় পরীক্ষাতেও বসেন। জেইই অ্যাডভান্সড–এর ফল প্রকাশিত হয়েছে। ফলে তারা অপেক্ষা না করে অনেকেই এনআইটি, আইআইটি–র মতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন।"
ওবিসি জটেই বাধা
রাজ্য সরকারের নয়া ওবিসি বিজ্ঞপ্তিতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ফলে রাজ্যে জয়েন্টের ওবিসি মেধা তালিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর ফলে সংরক্ষিত ও সাধারণ শ্রেণীভুক্ত পড়ুয়াদের জন্য নির্দিষ্ট আসন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড।
এই বোর্ড শুধু পরীক্ষা পরিচালনা, খাতা দেখা বা ফল প্রকাশ করে না, একই সঙ্গে আসন সংখ্যার বিন্যাস প্রকাশ করে ফলের সঙ্গে। এই আসন সংখ্যার ভিত্তিতে ভর্তি করা হয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, ছাত্র-ছাত্রীদের ডাকা হয় কাউন্সেলিংয়ে।
জুটার সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, "ফল কেন বেরোচ্ছে না, সেটা আমরা বুঝতে পারছি। এখন ওএমআর শিটে মূল্যায়ন করা হয়, বেশি সময় লাগে না। খাতা দেখা নিশ্চিতভাবেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফল বের করা হচ্ছে না বা বেরোচ্ছে না ওবিসি জটে। উচ্চশিক্ষা দপ্তর যে সেন্ট্রাল পোর্টাল খুলেছে, সেখানে ১৭ শতাংশ ওবিসি ও অন্যান্য ক্যাটেগরিকে যুক্ত করেছে। কিন্তু তার উপরে কলকাতা হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এর ফলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড বুঝতে পারছে না, তারা ১৭ শতাংশ নিয়ে কাজ করবে না সাত শতাংশ।"
সেভ এডুকেশন কমিটির রাজ্য সম্পাদক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তরুণ নস্কর বলেন, "বেসরকারি কলেজে ৬০ শতাংশ আসন ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এর মাধ্যমে আসলে সরকার পোষিত যে শিক্ষা ব্যবস্থা, তা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ওবিসি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সঙ্গে শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই, রাজনীতির সম্পর্ক আছে। সেটা আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছে। তার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমন অনেক পরীক্ষার্থীকে আমি জানি, যারা সেন্ট্রাল জয়েন্টে ভালো র্যাঙ্ক করেছে, এখানে আরো ভালো র্যাঙ্ক করার প্রত্যাশা তাদের রয়েছে। এর সুবাদে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু তারা ভর্তি হতে পারছে না, ফল প্রকাশিত না হওয়ায়।
যদিও আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, ওবিসি বিজ্ঞপ্তিতে স্থগিতাদেশ থাকলেও জয়েন্টের ফল প্রকাশ অতীতের সংরক্ষণের বিন্যাস অনুযায়ী করা সম্ভব।
কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক এক নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, ২০১০ সালের আগে যে ৬৬টি জনগোষ্ঠী তালিকায় ছিল, তাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেনি। এই ৬৬টি গোষ্ঠীকে ওবিসি হিসেবে গণ্য করে নিয়োগ বা ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোনো বাধা নেই।
কলকাতা পুরসভায় নিয়োগ সংক্রান্ত একটি মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি কৌশিক চন্দ গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, ডিভিশন বেঞ্চ পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, ৬৬টি গোষ্ঠী ও সাত শতাংশ সংরক্ষণের নীতি নিয়ে কাজ চালানো যেতে পারে।
আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "জয়েন্টের যে ফলাফল সেটা ২০১০-এর আগের, অর্থাৎ ২০০১ সালের যে রোস্টার, সেটা অনুযায়ী করা সম্ভব। এখানে ৬৬টি গোষ্ঠী এবং সাত শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে ভর্তি ও নিয়োগ প্রক্রিয়া চলতে পারে। এতে কোনো বাধা নেই।"