ছিল কারাগার, হলো স্বাধীনতার মিউজিয়াম
আগে ছিল কলকাতা আলিপুর সংশোধনাগার, এখন হলো জেল মিউজিয়াম। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই জেল গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসনে এই জেল ছিল কেন্দ্রীয় কারাগার।
নেতাজি, নেহরু, অরবিন্দরা বন্দি
আলিপুর জেলকে বর্তমানে একটি জাদুঘরে পরিণত করে তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ১১৬ বছর বয়সি এই কারাগারে ব্রিটিশ শাসনকালে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, সুভাষ চন্দ্র বসু, দীনেশ গুপ্ত থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু, বিধান চন্দ্র রায়ের মতো মানুষেরা বন্দি ছিলেন।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের কক্ষগুলি ব্রিটিশ-সুলভ শাস্তি ও শৃঙ্খলাপরায়ণতাকে মাথায় রেখে নির্মিত। সাধারণ কক্ষগুলির গঠন সেনা ছাউনির মতো। ঐতিহাসিকদের মতে, ব্রিটিশদের তৈরি এই কারাগার প্যানঅপটিকন স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত, যেখানে বন্দিদের ওপর সবসময় নজর রাখার ব্যবস্থা থাকে।
সর্বক্ষণ নজরদারি
কারাগারে নজরদারিতে কখনও কোনও ছেদ পড়তো না। প্রহরীরা পর্যায়ক্রমে এই লম্বা পরিসরটিতে নিয়মিত টহল দিতেন। সবসময় নজরদারির ব্যবস্থা ছিল। স্বাধীনতার পর অবশ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়।
ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য
কারাবাসের শাস্তি দেওয়ার মূল লক্ষ্য অপরাধীদের মানসিক সংস্কার ঘটানো। কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতে কারাবাসের লক্ষ্য ছিল অপরাধীদের মধ্যে শ্রেণিভেদ এবং অসাম্য তৈরি করা। কারাগারের নির্মাণশৈলিতে তা ধরা পড়ে।
বিপজ্জনক বন্দিদের জন্য
তৃতীয় শ্রেণির, সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দিদের মাটিতে রাখা হতো। দ্বিতীয় শ্রেণির বা তুলনামূলক কম বিপজ্জনক রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য সিমেন্টের তৈরি বিছানা বরাদ্দ ছিল। উচ্চশ্রেণির বন্দিদের আলাদা ঘরে রাখা হতো। ইউরোপীয় বন্দিদের স্থান হতো অন্য ওয়ার্ডে।
ইউরোপীয় বন্দিদের আলাদা ঘর
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ইউরোপীয় বন্দিদের জন্য পৃথক কক্ষ ছিল। ভারতীয় বন্দিদের তুলনায় ইউরোপীয় বন্দিদের প্রতি আলাদা আচরণ করা হতো। অনেক বেশি আরামে থাকতেন ইউরোপীয় বন্দীরা। ইউরোপীয় বন্দিরা ঈশ্বরের উপাসনা করার সুযোগও পেতেন। সেই উপাসনা গৃহ এখনকার ওয়াচ টাওয়ার।
ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য
মেকলে কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের মনোভাব কারাগারের নির্মাণশৈলীতে প্রকট। কারাকক্ষগুলি বানানো হয়েছে বন্দিদের আলাদা করে একাকী নির্জনবাসে রাখার উদ্দেশ্যে। কক্ষগুলিতে অপ্রশস্ত পাথরের বিছানা এবং মাথা রাখার উল্লম্ব অংশ পাশের বিছানার বিপরীতে দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল যাতে অবসর সময়েও দুইজন বন্দি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে না পারে।
জাতি, লিঙ্গ, অপরাধ দেখে
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ভিতরের অংশটি কয়েকটি নির্দিষ্ট কক্ষে বিভক্ত। জাতি, লিঙ্গ এবং অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে বন্দিদের পৃথক করা হতো। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের এই ব্যবস্থা অনুসরণ করে পরে দেশের সব কারাগারে এই নিয়ম চালু করা হয়।
পাঠভবন
বন্দিদের শিক্ষা দেয়া নিয়ে একটি প্রস্তাব নাকচ করা হয়। কারণ বলা হয়েছিল, এতে খরচ বেশি হবে এবং দোষীদের পুরস্কার দেয়া হবে। ২০০৭ সালে বাম আমলে বন্দিদের শিক্ষা এবং উচ্চতর ডিগ্রি পেতে সাহায্যের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল কারাগারের ভিতরের শিক্ষাকেন্দ্র ‘পাঠভবন’।
ফাঁসির মঞ্চ
ঐতিহাসিক আলিপুর জেলের এখানেই দীনেশ গুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দীনেশ মজুমদারের মতো অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসি হয়েছিল।
জেল হাসপাতাল
আলিপুর জেলের অভ্যন্তরীন হাসপাতাল। বর্তমানে এটি সংগ্রহশালা। ১৯৩০-এ বিধান রায় যখন আলিপুর জেলে বন্দি হন, তিনি রাজবন্দির মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, সশ্রম কারাদণ্ড নেবেন, আর শ্রম দেবেন জেল হাসপাতালের বন্দি রোগীদের দেখে। জেলে থাকাকালীন তিনি প্রতিদিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা করতেন।
বন্দি নেহরু
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুও বন্দি ছিলেন এই কারাগারে। তার ৭৯ দিনের বন্দিদশায় কন্যা ইন্দিরা বাবার সঙ্গে দেখাও করতে এসেছিলেন এই জেলে।
তাঁতকল
সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের কারাবাসে থাকাকালীন বিভিন্ন কাজ করতে হয়। আলিপুর জেলে ছাপাখানা এবং তাঁতকল ছিল। সেই তাঁতকলটি দর্শকদের দেখার জন্য নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
জেল থেকে মিউজিয়াম
২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সংশোধনাগার থেকে বন্দিদের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে স্থানান্তরিত করে। হাউজিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এই মিউজিয়াম তৈরি করে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশা প্রকাশ করেন যে জাদুঘরটি 'ঐতিহ্য স্পট' এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হবে।