ছানি অপারেশন করতে গিয়ে অন্ধ হতে হলো
গার্ডেনরিচের এক হাসপাতালে ছানি অপারেশন করাতে গিয়ে কার্যত অন্ধ হতে হয়েছে একাধিক মানুষকে।
কলকাতা মেডিক্য়াল কলেজে
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমলোজি বিভাগ। ২০৮ নম্বর ঘর। মেয়ের জামাইয়ের কাঁধে হাত দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ৮০ নম্বর বেডে এসে বসলেন গোবিন্দ দেবনাথ। গত মাসের ২৮ তারিখ তার চোখের ছানি অপারেশান হয়েছিল গার্ডেনরিচের নাদিয়াল হাসপাতালে। তারপর থেকে সেই চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না।
একই সমস্যায় ৩২ জন
শুধু গোবিন্দ নন, একই সমস্যায় রয়েছেন এমন আরও ৩২ জন, যাদের অপারেশন মেটিয়াব্রুজ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে হয়েছিল, যা গার্ডেনরিচ নাদিয়াল হাসপাতাল নামেও পরিচিত। রোগীর পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, অপারেশন থিয়েটার জীবাণুমুক্ত করার জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
চোখে ইনফেকশন
পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি গোবিন্দের ছানি অপারেশনের পর যেদিন চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হয় সেদিন থেকে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। চোখে ইনফেকশনও লক্ষ্য করা যায়। একই রকম লক্ষণ বাকি রোগীদের মধ্যেও দেখা গেছে। তারপর তাদের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমলোজি বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয়।
কলকাতায় এসে বিপত্তি
রিজওয়ানা পারভিন। সুদূর আসানসোল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন সুচিকিৎসার আশায়। গার্ডেনরিচে মেয়ের বাড়িতে থেকে জুন মাসের ২৮ তারিখ অপারেশন করান মেটিয়াব্রুজ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। চোখের সংক্রমণের কারণে তিনিও অপারেশনের পর থেকে ডান চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। তাকেও আরআইও-তে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
আইনি পদক্ষেপের ভাবনা
রিজওয়ানার কন্যা সাবা আফরিন জানালেন, আরআইও-র চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন তার মায়ের দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে না। তিনি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন।
সরকারি হাসপাতালে ভরসা নেই
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর ভরসা হারিয়ে এই রোগীদের অনেকেরই পরিবারের লোকজন তাদের বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছেন। খাদ্য ব্যবসায়ী আব্দুল রহমানের পরিবারের লোকেরা তাকে বাড়ি নিয়ে চলে এসেছেন। অন্য চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা চালাচ্ছেন।
মেয়রের কাছে নালিশ
আব্দুল রহমানের ভাই আব্দুল রহিম জানালেন, এই ঘটনার পর তারা এলাকার বিধায়ক, যিনি কলকাতা শহরের মেয়রও, সেই ফিরহাদ হাকিমের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। ফিরহাদ বলেছেন, একটি চিঠি লিখে জমা করতে, তিনি তা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেবেন।
হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ
গত মঙ্গলবার আব্দুলদের মতো অনেক পরিবারই নাদিয়াল হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ দেখান। তারা বলছেন, হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাদের বলা হচ্ছে, রোগীর অসাবধানতার কারণেই এই সমস্যা হয়েছে। পরিবারের লোকেদের বক্তব্য, যদি রোগীর অসাবধানতাতেই এই দুর্ঘটনা ঘটবে, তাহলে এতজন রোগীর একই সঙ্গে একই সমস্যা কীভাবে সম্ভব!
স্বাস্থ্য দপ্তরের কমিটি
এই অপারেশন কাণ্ডের পরেই স্বাস্থ্য দপ্তর একটি কমিটি তৈরি করে। গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যভবনে সেই কমিটির জমা দেওয়া রিপোর্টে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, ছানি অপারেশনের সময় ব্যবহৃত ফ্লুইডের বোতলে ছত্রাক থাকার কারণে এই সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। চোখের অপারেশনের সময় একরকম জেলি ব্যবহার করা হয়, সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে সেই জেলির গুনমাণ নিয়েও।
হাসপাতাল পরিদর্শন
হাসপাতালের ওষুধপত্র সরবরাহ করা হয় রাজ্য সরকারের সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর থেকে। ওষুধের মান নিয়ে রিপোর্ট সামনে আসার পরই সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরের কর্তাব্যক্তিরা হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। ওইসব ওষুধপত্রের নমুনা সংগ্রহ করেন। বাকি ওষুধগুলি আপাতত ব্যবহার না করার নির্দেশ দেন।
যে প্রশ্নগুলি উঠছে
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর রোগীর পরিবারের মধ্যে চাপানউতরের মাঝে কতকগুলি প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে থেকেই যাচ্ছে। সরকারি হাসাপাতালের চিকিৎসা আদৌ কতটা নিরাপদ? একই হাসপাতালে এতগুলো মানুষের ছানি অপারেশানের পর একই সমস্যায় ভোগা, এটা কি কাকতালীয়, নাকি রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালসার অবস্থার ছায়াছবি?