খুব বেশিদিনের কথা নয়, চৌদ্দমাস আগে আদালতে চার্জশিট ফাইল করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জানিয়েছিল সাবেক তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান সন্দেশখালি ও তার আশপাশের এলাকায় ১৮০ বিঘে জমি দখল করে নিয়েছিল। তার দাম ২৬১ কোটি টাকা। এই কাজে তার সহযোগী ছিল ভাই শেখ আলমগীর ও দুই অনুগামী দিদার বক্স মোল্লা ও শিবপ্রসাদ হাজরা। তার মধ্যে ২৭ কোটি টাকা ইডি বাজেয়াপ্ত করতে পেরেছে। ভাবুন একবার, ভয় দেখিয়ে, মারধর করে, সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে ১৮০ বিঘে জমি জবরদখল করে নিলো শেখ শাহজাহান। উঁচু মহলের সাহায্য ছাড়া কি কেউ এই কাজ করতে পারে?
এর এককথার জবাব, সম্ভব নয়। যেখানেই মাফিয়া রাজ ফুলেফেঁপে ওঠে, সেখানেই রাজনীতি, মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার একযোগে কাজ করে। তাদের সামনে সাধারণ মানুষ অসহায় আত্মসমর্পণ করে। আর অত্যাচার যখন সীমা ছাড়ায়, তখন সন্দেশখালির মতো বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়। তারপর আবার যে কে সেই। এক শাহজাহান কারান্তরালে থাকলে কী হবে, অন্য শাহজাহান অন্য জায়গায় তৈরি হয়। দখলদারি ও তোলাবাজির তাজমহল গড়ে উঠতেই থাকে।
মোটামুটি সিন্ডিকেট বিষয়টা প্রায় সকলেই জানেন, তাও পরীক্ষার আগে পড়া ঝালাই করার মতো বলে দেওয়া ভালো, পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডেকেট রাজ হলো, এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে গুণ্ডাদের কথাই হলো শেষ কথা। ধরুন, আপনি বাড়ি তৈরি করছেন, সেখানে কে আপনাকে বালি দেবে, কে স্টোন চিপস দেবে, কে সিমেন্ট দেবে, কে লোহা দেবে সেসব এলাকার সিন্ডিকেটের দাদারা ঠিক করে দেবে। বাজারের দামের থেকে বেশি দাম দিয়ে ওই ঠিক করে দেওয়া মানুষের কাছ থেকেই আপনাকে বালি, সিমেন্ট, লোহা. স্টোন টিপস ইত্যাদি কিনতে হবে। যদি না কেনেন তাহলে আপনার বাড়িই তৈরি হবে না। তাদের দাপটে অন্য কেউ আপনাকে বালি ইত্যাদি সরবরাহ করবে না। ধরা যাক, এক হাজার ইটের দাম পাঁচশ টাকা। সিন্ডিকেট বলে দেবে, আপনাকে আটশ টাকা দিয়ে ইট কিনতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের এই সিন্ডিকেটরাজ এভাবেই কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরছে।
ধরুন, যাদের পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির সঙ্গে সম্যক পরিচিতি নেই, তারা প্রথম প্রথম কথাগুলো বিশ্বাস করতেন না। দিল্লিতে অনেকে বলেছেন, আরে এ তো নিশ্চয়ই গল্পকথা। তাদের সামনে তখন তৃণমূল নেতাদের বিবৃতি ও সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট খুলে দেখাতে হয়। ২০১৪ সালের ঘটনা। আনন্দবাজারে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী বলেছেন, "দলের মধ্যে সিন্ডিকেট রাজ চলতে দেব না। দলের নাম ভাঙিয়ে টাকা তোলা, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে খেতে দেব না। আমি যত দিন দলের জেলা সভাপতি আছি, এসব চলবে না। সব জানি, কে কোথায় কী করছেন। দেখে যাচ্ছি। দলনেত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। সময় মতো ব্যবস্থা নেবো।'' সৌরভ এখানে প্রকল্প নিয়ে যে কথা বলছেন, তা হলো সরকারি প্রকল্প। সেই প্রকল্পের সুবিধা পেতে গেলে ২০ শতাংশ কাট দিতে হয়, এটাই দস্তুর। সিন্ডিকেট একটা সর্বব্যাপী ব্যবস্থা। যেখানে টাকা, সেখানেই সিন্ডিকেট, সেখানেই তা লুট করার ফন্দিফিকির।
এই যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সৌরভ চক্রবর্তী বললেন, তা শুধু তিনি কেন, দলনেত্রীও অনেকবার বলেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি সব দেখছেন, সব জানেন, এবার ব্যবস্থা নেবেন। তারপরেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় কোথায়? শেখ শাহজাহানের মতো যারা খুব বাড়াবাড়ি করছে, তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। শেষপর্যন্ত জেলে যেতে হয়, কিন্তু সিন্ডিকেটতন্ত্র চলতে থাকে। জবরদখলের ক্রম চলতেই থাকে। সল্টলেকের মতো কলকাতার অভিজাত অঞ্চলে সিটি সেন্টারের কাছে দেখবেন, জমির বাইরে নোটিশ বোর্ড আছে, এটা সরকারের জমি। কোন দপ্তরের জমি তাও বলা আছে। আর সেই জমিতে সার সার ঝুপড়ি বাড়ি। জমি জবরদখল হয়ে গেছে। শেখ শাহজাহানরা সাধারণ মানুষের জমি নিয়ে জবরদখল করত। আর এখানে সরকারি জমি জবরদখল হয়ে গেছে। আর ওই যে বললাম, এরকম ক্ষেত্রে রাজনীতি, মাফিয়া, আধিকারিক সাধারণত সব একসুরে বাজে। তাহলেই তো সিস্টেমটা তেল দেওয়া মেশিনের মতো চলবে না।
২০১৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত বলেছিলেন, ‘‘সল্টলেক ও আসানসোলে বিচার বিভাগের দুইটি ভবন তৈরির কাজে নিযুক্ত সরকারি ঠিকাদারকেও হুমকি দিচ্ছে সিন্ডিকেটের লোকজন। তারা চাইছে, তাদের দাবি মতো ইমারতি জিনিসপত্র নিতে হবে। না হলে কাজ বন্ধ। রাজ্যের সর্বত্র এই ঘটনা ঘটছে। এমনকি বিচারব্যবস্থার উপরেও এর প্রভাব পড়েছে।'' বুঝুন কাণ্ডখানা।
স্বাভাবিকভাবে সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে লড়াইও হয়। তিন বছর আগে গড়িয়া মোড়ের পাঁচ নম্বর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জায়গা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ফুটপাথে একজন হকারকে বসতে না দেওয়া নিয়ে ঝামেলা শুরু। তারপর হকার সিন্ডিকেটের সঙ্গে অটো সিন্ডিকেটের ব্যাপক লড়াই হয়। রিপোর্ট বলছে, সব বিষয়ে সিন্ডিকেটের দাদাদের আশীর্বাদ দরকার হয়। তাহলে পুলিশ কিছু বলবে না। দাদাদের ঠিক করে দেওয়া রুটে অটো চালানো যাবে, যেমন খুশি চালানো যাবে। তার জন্য দর্শনী তো দিতেই হবে। অটো, ট্যাক্সি সকলকেই প্রথমে একটা থোক টাকা দিতে হয়। তারপর প্রতি মাসে দুইশ-তিনশ বা তার বেশি টাকা দিতে হয়। লক্ষীর ভাণ্ডার কি শুধু সরকারের আছে, সিন্ডিকেটেরও আছে।
আবার শাহজাহানের উদাহরণে ফিরি। শাহজাহান গ্রেপ্তার হওয়ার পর চাপের মুখে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে শুরু করে। প্রথম সাত দিনে সাতশ অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে ১৫০টি জমি দখল সংক্রান্ত, ৭০টি তোলাবাজির। রাজ্যে শিল্প নেই, চাকরি বাকরি নেই, বেকার ছেলেরা তাই ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় একটু জবরদখল করবে, তোলাবাজি করবে, কাটমানি নেবে, এটা এখন ওপেন সিক্রেট। ভোট এলেই সিন্ডিকেটের টাকা সেখানেও ঢুকে যায় বলে নিন্দুকরা অভিযোগ করে। বেনিয়মই যেখানে নিয়ম, সেখানে এই সব ছোটখাট বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে চলে নাকি! আজকের দিনের সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স হলো, আমরা সবকিছু দেখি, অথচ কিছুই দেখি না।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই এরকম হচ্ছে তা মনে করার কারণ নেই। ২০২০ সালে পুলিশের হেফাজতে মৃত উত্তরপ্রদেশের গ্যাংস্টার বিকাশ দুবে জমিদখল ও প্রোটেকশন মানি নিয়ে ১০ কোটিরও বেশি টাকা কামিয়েছিলেন বলে নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট বলছে। গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে তার সম্পত্তি ছিল। ঝাড়খণ্ডের কাহিনি তো আরো মনোহর। আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এক হাজার আটশ একর জমি মাফিয়ারা হাতিয়ে নেয়। যার দাম তিন হাজার কোটি টাকা। হরিয়ানাতে একের পর এক জমিদখলের অভিযোগ এসেছে। গাজিয়াবাদ, নয়ডা, প্রয়াগরাজের মতো জায়গা তো জমিদখল ও টাকা আদায়ের জন্য বহুবার শিরোনামে এসেছে।
ভারতে অনেক রাজ্যে অরণ্যের প্রাচীণ প্রবাদের মতো একটা প্রবাদ তৈরি হয়েছে, ক্ষমতা যার, জমি তার, তোলা তার, চাঁদা তার।