কোলাপুরি চপ্পল বিতর্কের দায় কি শুধু প্রাডার?
৪ জুলাই ২০২৫বিগত কয়েক দিনে ইটালির বিলাসবহুল ব্র্যান্ড প্রাডা গ্রুপের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক চুরির অভিযোগ উঠেছে। মিলান ফ্যাশন উইকে তাদের পুরুষদের সংগ্রহে প্রদর্শিত চামড়ার স্যান্ডেল আসলে ভারতের ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি চপ্পলের নকল বলে দাবি করা হচ্ছে।
দ্বাদশ শতাব্দীর পুরনো এই কারুশিল্পের আধারে তৈরি এই জুতো-জোড়ার বিনিময়ে বিলাসবহুল এই ফ্যাশন হাউস এক লক্ষ টাকার বেশি দাম নির্ধারণ করতে পারে, যেখানে মূল কারিগরদের তৈরি চপ্পল মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকায় পাওয়া যায়। ভারতীয় ফ্যাশন সমালোচক ও কারিগরদের প্রতিবাদের মুখে এখন প্রাডা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটি কেবল একটি ডিজাইন বিতর্ক নয়, বরং স্থানীয় কারিগরদের অর্থনৈতিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার প্রশ্ন। মহারাষ্ট্র বাণিজ্য সংস্থা প্রাডার কাছে তাদের ডিজাইনের ভারতীয় উৎস স্বীকারের দাবি জানায়।
স্বীকৃতি সত্ত্বেও অনিশ্চয়তা
প্রাডা গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে তারা ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি চপ্পলের থেকে অনুপ্রাণিত স্যান্ডেল তাদের মিলান ফ্যাশন শোতে প্রদর্শন করেছে। কোম্পানি স্বীকার করেছে যে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের স্থানীয় কারিগরদের ঐতিহ্যবাহী নকশা ব্যবহার করা হয়েছে এবং তারা এই কারিগর সম্প্রদায়ের সাথে সংলাপ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মহারাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
ভারতীয় কারিগরদের কাছে এটি বিজয়ের মতো মনে হলেও, এই স্বীকৃতি কিছুটা প্রসঙ্গ ধামাচাপা দেওয়ার কর্পোরেট চেষ্টা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে এমন আচরণ নতুন কিছু নয়। যোগ থেকে আয়ুর্বেদ, হলুদ থেকে নিম - কোলাপুরি চপ্পলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবারের প্রতিবাদ হয়ত দ্রুত ছিল, কিন্তু ফলাফল সন্দেহজনক। সামাজিক মাধ্যমে চাপ এবং বাণিজ্যিক সংস্থার হস্তক্ষেপ বহুজাতিক কোম্পানিকে কেবল মুখে স্বীকার করতে বাধ্য করেছে। প্রকৃত ক্ষতিপূরণ বা দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পাবেন কি কারিগররা? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অস্পষ্ট।
শিল্প ও শিল্পীদের প্রতি অবহেলা
কিন্তু এই প্রশ্নের সামনে শুধু প্রাডা নয়, আমাদেরকেও দাঁড়াতে হবে। আমাদের শিল্প ও শিল্পীদের সংরক্ষণে আমরা কী করেছি? সরকার এবং সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর কেন জেগে ওঠে? আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঐতিহ্য ও গর্বের দাবি করা চমৎকার জনসংযোগ কৌশল, কিন্তু এই কারিগর এবং শিল্পকলার প্রকৃত অবস্থা কী? স্থানীয় বাজারে যে চপ্পল হাজার টাকায় বিক্রি হয়, তার পেছনে কারিগরের পারিশ্রমিক কত? তাদের সন্তানরা কি এই পেশায় আগ্রহী? নাকি আরও লাভজনক কাজের খোঁজে শহরমুখী হচ্ছে?
এই শিল্পকলার রয়েছে এক জটিল অতীত। ২০১৯ সালে জিআই ট্যাগ পাওয়া এই জুতোর কারিগররা সামাজিক বর্ণক্রমের নিম্নস্তরের প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে মহারাষ্ট্রের হিন্দু বর্ণব্যবস্থার মুচি-জাতি চামার এই জুতো তৈরি করে আসছে। যদিও এটি দ্বাদশ শতাব্দী থেকে তৈরি হয়ে আসছে, এই চামড়ার স্যান্ডেল বিংশ শতাব্দীতে কোলাপুরি চপ্পল নামে পরিচিতি পায়। তৈরির প্রক্রিয়ায় পশুর চামড়া শুকানোর কারণে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যান্য সম্প্রদায় চামার সম্প্রদায়ের থেকে দূরত্ব বজায় রাখত এবং এই দলিত সম্প্রদায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। চপ্পল তৈরিতে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস সময় লাগে। নকশা ও খোদাইয়ের কাজ করেন পরিবারের মহিলারা। ২০১৯ সালে জিআই ট্যাগ পেলেও ২০১৫ সালের মধ্যে এই শিল্প গুরুতর সংকটে পড়ে। দেশব্যাপী গোহত্যা নিষিদ্ধ হওয়ার পর মহারাষ্ট্রে ষাঁড়, বলদ ও বাছুর জবাইও নিষিদ্ধ হয়। এর ফলে সব কসাইখানা বন্ধ হয়ে যায়। পরে একে একে চামড়া ট্যানারি গুলোও বন্ধ হতে থাকে।
প্রতিকূল পরিবেশ
যা একসময় নিজস্ব কারখানায় তৈরি হতো, এখন তা আনতে হয় বাইরে থেকে। কোলাপুরি চপ্পল নির্মাতারা এখন তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের মতো রাজ্য থেকে চামড়া আমদানি করেন। এতে খরচ বাড়ে অনেকগুণ। ঐতিহ্যবাহী চামড়া প্রক্রিয়াকরণে পশুর চামড়া চুন ও লবণে ভিজিয়ে রাখা হতো, তারপর হিরদা ও বাবুলের মতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হতো। কিন্তু এখন চেন্নাইয়ের মতো জায়গা থেকে আসা চামড়া রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত।
এই অতিরিক্ত খরচ পুরোটাই বহন করেন কারিগররা। সরকার পশু নিষ্ঠুরতা, ধর্ম ও দূষণের প্রশ্নে ব্যস্ত, কিন্তু যে কারিগর আর শিল্পের জন্য তারা গর্ব করে, তাদের দেখাশোনা করছে কে? সরকার কারিগরদের বিকল্প ব্যবস্থা দেয়নি, খরচেও ভর্তুকি দেয়নি। কসাইখানা ও চামড়া কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তাদের যে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, তার দায়ভার নিজেদেরই কাঁধে।
দুর্দশার সাথে যোগ হয়েছে আরেক সমস্যা - বাজার এখন নকল পণ্যে ভরে গেছে। মুষ্টিমেয় কারিগরই জিআই সার্টিফিকেট পেয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী কারিগররা নকশায় স্থবিরতায় ভুগছেন, যা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে। কোলাপুরি চপ্পল নির্মাতারা মূলত স্থানীয় বাজারেই সীমাবদ্ধ।
প্রাডার সাথে এই আলোচনায় উপকৃত হওয়া উচিত প্রকৃত নির্মাতাদের - যে দলিত সম্প্রদায় ঐতিহ্যগতভাবে এই কাজে জড়িত, তাদের উপর আলোকপাত করা দরকার। সাংস্কৃতিক আত্মসাৎ নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমাদের ঐতিহ্য ও পরিচয় রক্ষার লড়াই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই চলে আসছে। উত্তর ভারতে জনপ্রিয় ছিঁটের কাপড় মূলত কাঠের ব্লক বা হাতে আঁকা নকশার বৈচিত্র্যময় কাপড়। ইউরোপীয় আমদানিকারকরা এর বৈচিত্র্যের সরলীকরণ করে চিনৎজ নামে জনপ্রিয় করেছিল।
শুধু কোলাপুরি নয়, বিপণ্ণ আরও পণ্য
স্বীকৃতি ছাড়া আত্মসাতের এই লড়াই নতুন নয়। এ বছরের শুরুতে সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছিল 'স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্কার্ফ' - যা আসলে আমাদের সাধারণ দুপাট্টা ছাড়া আর কিছুই না। আজকের ব্যান্ডানা এসেছে আমাদের বাঁধনি ঐতিহ্য থেকে। কাশ্মীরি পশমিনার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও জটিল কারুকাজ পশ্চিমী ফ্যাশন হাউসগুলো বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিক্রি করে আসছে। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার পল স্মিথ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তার কালো চামড়ার স্যান্ডেলের জন্য, যার বিজ্ঞাপনে নাম দেওয়া হয়েছিল 'রবার্ট'। পাকিস্তানিরা নকশাটি চিনে নিয়েছিল ঐতিহ্যবাহী পেশাওয়ারি (বা চারসাদ্দা) চপ্পল হিসেবে - তবে পল স্মিথের মডেল পাকিস্তানের দামি দোকানের একই চপ্পলের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দামে বিক্রি হতো। সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা ও অনলাইন পিটিশনের পর ডিজাইনার দ্রুত জুতোর বর্ণনায় যোগ করেন যে এটি পেশাওয়ারি চপ্পল থেকে অনুপ্রাণিত'। তাই প্রাডার স্বীকৃতি নিয়ে আমাদের সন্দেহ অমূলক নয়।
প্রাডার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সহজ, কিন্তু নিজেদের অবহেলার জবাব দেওয়া কঠিন। বছরের পর বছর উপেক্ষিত এই শিল্প এখন বিদেশী কোম্পানির কাছে চুরি হয়ে গেলে আমরা জাতীয় গর্বে আহত হই। কিন্তু এই গর্বের মূল্য কারিগরদের পেটে ভাত জোগায় না। এই বিতর্কের দায় শুধু প্রাডার নয় - প্রশ্ন তোলা উচিত আমাদের সরকার ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। যে ধর্মের নামে গরু কিংবা গবাদি পশু সংরক্ষণে সরকার কঠোর, সেই ধর্মের বর্ণ ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচে পড়ে থাকা মানুষের কথা কেউ ভাবে না- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাহলে সেই সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেও আমরা আমাদের বলে দাবি করতে পারি না।
কোলাপুরি চপ্পলের এই ঘটনা দেশের সরকার ও নাগরিকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে কারিগরদের সমস্যা সমাধানেই মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কোনো শিল্পকলা সংরক্ষণের একমাত্র উপায় হলো নির্মাতাদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। প্রাডার সাথে এই আলোচনা যদি শুধু কূটনৈতিক বিজয়ের গল্প হয়ে থাকে, তাহলে আসল কারিগরদের কিছুই পাওয়া হলো না। সাংস্কৃতিক আত্মসাতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আগে নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিতে হবে। সম্ভবত আমরা যদি শিল্প ও শিল্পীদের সংরক্ষণ ও ক্ষমতায়নে আরও মনোযোগী হই, তাহলে স্বীকৃতি ছাড়া আমাদের সংস্কৃতি আত্মসাৎ করা এত সহজ হবে না। ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার প্রতি সম্মান দেখানোর দায়িত্ব শুধু বিদেশী কোম্পানির নয়, আমাদেরও।
এলিজাবেথ গ্রেনিয়ার/এসএসজি/এসবি