কোভিডে অনাথ শিশুদের দত্তক নেয়ায় আগ্রহ বাড়ছে
২৯ অক্টোবর ২০২২২০২০-২১ সালে করোনা অতিমারিতে দেশের বহু শিশু তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে৷ এর পরেই পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে দত্তক গ্রহণের হার৷ নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রকের অধীন সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি (সিএআরএ বা কারা) সম্প্রতি দত্তক সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গে দত্তক নেওয়ার হার বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি৷ ভারতে বাংলার স্থান চতুর্থ৷ এই শিশুদের মধ্যে একটা বড় অংশ কন্যা সন্তান৷
সিএআরএ ২০২০-র এপ্রিল থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত দেশে সমীক্ষা চালায়৷ এই সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে শিশু দত্তকের হার হ্রাস পেয়েছে ৮.৮ শতাংশ৷ একই সময়ে বাংলায় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ৷ পশ্চিমবঙ্গে অতিমারির সময়ে ৭৪১টি শিশু তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে৷ এর মধ্যে ২৩ জনের ঠাঁই হয়েছে সরকারি হোমে৷ বাকিদের একাংশ থাকছে পরিজনদের সঙ্গে৷ বাকি অংশকে দত্তক নেওয়া হয়েছে৷
২০১৯-২০ সালের মধ্যে ভারতে ৩ হাজার ৩৫১টি শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়৷ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যা ২০৮৷ ২০২১-২২ সালের মধ্যে দেশে এই সংখ্যা ২ হাজার ৯৯১৷ একই সময়ে বাংলায় ২২৯টি শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়৷অর্থাৎ দেশে যে হার নিম্নমুখী, তা এ রাজ্যের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী৷ পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে তিনটি রাজ্য৷ সাম্প্রতিকতম হিসেবে মহারাষ্ট্রে ৪৯৯ জন দম্পতি দত্তক নিয়েছেন৷ তামিলনাড়ুতে ২৯৪ এবং কর্নাটকে ২৫০টি শিশু নতুন পরিবার পেয়েছে৷
পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে রাজ্যের শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ৷ সংস্থার চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দত্তক নিয়ে আমরা সচেতনতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি৷ কোভিডের সময় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল প্রচারে৷ এর ফলে মানুষের চেতনা বেড়েছে৷ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সিএআরএ-র মাধ্যমে শিশুদের দত্তক নেওয়া হচ্ছে৷''
কোভিডের আগে দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা এতো আশাব্যঞ্জক ছিল না। কয়েকটি বছর রাজ্যে দত্তক নেওয়ার হার ছিল পড়তির দিকে৷ সিএআরএ-র হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে ২০৩টি শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ সালে এই সংখ্যা ১৬৮ এবং ২০১৮-১৯ সালে ১৬১৷ সেই তুলনায় রাজ্যে দত্তক গ্রহণের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে৷
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানকে স্বাগত জানিয়েছেন সমাজকর্মীরা৷ অধ্যাপক, সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দম্পতিরা যে দত্তক নিতে এগিয়ে আসছেন, রাজ্যে তার সংখ্যা বাড়ছে, এটাই যথেষ্ট আশাপ্রদ খবর৷ দত্তক নেওয়ার সময় একটি শিশুর ইতিহাস জানা সম্ভব হয় না৷ একটি অজ্ঞাতকুলশীল শিশুকে আপন করে নেওয়া খুবই ইতিবাচক৷''
ভারতে শিশুকে দত্তক নেওয়ার পদ্ধতিটা সরল নয়৷ কোনো অনাথকে শিশুকল্যাণ কমিটির সামনে হাজির করাতে হয়৷ এরপর তার ঠাঁই হয় স্পেশ্যালাইজড অ্যাডপশন এজেন্সি (এসএএ বা সা)-তে৷ সেখান থেকে সিএআরএ-র মাধ্যমে কোনো দম্পতি শিশুকে দত্তক নিতে পারেন৷ এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়৷ এক থেকে দুই বছরের মতো৷ আইনি জটিলতার জন্যও দেরি হয়৷ অনেকের মতে, এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য বেআইনিভাবে শিশুর লেনদের প্রবণতা এখনো রয়েছে৷ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে জন্ম নেওয়া সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা শোনা যায়৷ এ ছাড়া শিশু পাচারের অভিযোগ রয়েইছে৷
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে এসএএ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে৷ বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে৷ তবু শিশু বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি৷ সুদেষ্ণা বলেন, ‘‘শিশু বেচাকেনা একটা ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এটা বন্ধ করতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে৷ অনাথ শিশুকে পুলিশ ও শিশুকল্যাণ কমিটির মাধ্যমে এসএএ-তে পাঠানো উচিত৷'' শাশ্বতীর বক্তব্য, ‘‘সরকারি সতর্কতা সত্ত্বেও শিশু পাচার রোখা যায়নি৷ দত্তকের প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে শিশুকে নেওয়ার ঝোঁক এখনো রয়েছে৷ বেআইনিভাবে দত্তক নেওয়ার পরও সেই শিশুকে দম্পতির কাছ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে৷ এ ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনকে আরো তৎপর হতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের৷