কোন দিকে যাচ্ছে জার্মানির শান্তি আন্দোলন?
২২ এপ্রিল ২০২৫গেল সপ্তাহান্তে ইস্টারের বন্ধে জার্মানির প্রায় ১২০টি এলাকায় ঐতিহ্যবাহী শান্তি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ষাটের দশকে ইস্টারের পরমাণু অস্ত্রের বিরোধিতা করে এই শান্তি আন্দোলন শুরু হয়। সেই চর্চা এখনো চলছে।
অথচ, সম্ভাব্য নতুন চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎসের নেতৃত্বে আসন্ন সরকার শত শত কোটি ইউরো খরচ করে জার্মানির সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে সেনাসংখ্যা এখন ৮৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ তিন হাজারে নিতে একটি নতুন স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি চালু করতে চায়।
যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে জার্মান জনমতও বিভক্ত। গবেষণা সংস্থা ফরসা মার্চ ও এপ্রিলে জরিপ করে দেখিয়েছে, অধিকাংশ জার্মান (৫৪%) আশঙ্কা করেন দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতি ছয়জনের একজন দেশটির পক্ষে লড়াই করতে প্রস্তুত।
এবারের ইস্টার মিছিলগুলো ছিল বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি মিছিলই বিভিন্ন বৈশ্বিক সংঘাতের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা দাবি জানিয়েছে। তবে ‘জার্মান পিস মুভমেন্ট' নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এসব মিছিল সমন্বয় করছেন ক্রিস্টিয়ান গোল্লা। তিনি বলেন, সব মিছিলেই যে সাধারণ বার্তাগুলো ছিল, তা হলো, জার্মানি ও ইউরোপে অতিরিক্ত অস্ত্র সংগ্রহের বিরোধিতা, কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান- বিশেষ করে ইউক্রেন ও গাজায়, পরমাণু অস্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্তির দাবি এবং ইউরোপে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের বিরোধিতা।
গোল্লা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি মনে করি, এটা দেখানো গুরুত্বপূর্ণ যে বিকল্প পথও আছে।” "সমরাস্ত্রের মজুত বাড়ানোর পথই কি সঠিক?” - প্রশ্ন করে তিনি।
তিনি বলেন, "রাজনীতিবিদেরা যে সমাধান দিচ্ছেন, তা আদৌ কার্যকর কিনা আমি নিশ্চিত নই। রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখল করে, তাহলে কি ওরা পশ্চিম ইউরোপও দখল করে নেবে? আমার সন্দেহ আছে।”
গোল্লা আরো বলেন, শান্তি আন্দোলনের সবাই যে সহিংসতার সম্পূর্ণ বিরোধী, এমন নয়। তিনি বলেন, এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হল প্রশ্ন তোলা।
শান্তিবাদীদের জন্য কঠিন সময়
বার্লিনের হামবল্ডট বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও শান্তিবাদী ওলাফ ম্যুলার মনে করেন, জার্মানির শান্তি আন্দোলন বর্তমানে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, "শান্তি আন্দোলন এখন আশাহত। আজ যদি কেউ সামরিকবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে, তবে সাথে সাথে তাকে পুটিনের পক্ষের লোক মনে করা হয়।”
বলা হচ্ছে, আজকের শান্তি আন্দোলন ১৯৮০-র দশকের মতো শক্তিশালী নয় । তখন শীতল যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনগুলো পূর্ব ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছিল।
যেমন, ১৯৮৩ সালে প্রায় ৪০ লাখ পশ্চিম জার্মান নাগরিক ‘ক্রেফেল্ড আপিল' -এ স্বাক্ষর করেন। সেখানে পশ্চিম জার্মানিতে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন না করার দাবি জানানো হয়েছিল। এই দাবিই এবার ইস্টার মিছিলের অন্যতম প্রধান দাবি।
আজকের জার্মানরা যুদ্ধ নিয়ে আগের চেয়ে বেশি আতঙ্কিত, বিশেষ করে হোয়াইট হাউসের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। ম্যুলার বলেন, "জার্মানরা এখন ভীত, কারণ তারা আর নিশ্চিত নয় যে ন্যাটো চুক্তির নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি বজায় থাকবে।”
ম্যুলার বিশ্বাস করেন, সামরিক প্রতিরক্ষার বিকল্প রয়েছে। যদি জার্মানি আবার সামরিক বাধ্যতামূলক সেবা চালু করে, তবে সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণের পরিবর্তে মানুষকে অহিংস প্রতিরোধ এবং অসহযোগ আন্দোলনের প্রশিক্ষণের বিকল্পও দেওয়া উচিত। ইউক্রেনের কোনো কোনো শহরে এমনটাই হয়েছে। সেখানে মানুষ অহিংস উপায়ে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
কোন দিকে যাচ্ছে শান্তি আন্দোলন?
‘সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস' বইয়ের লেখক আন্নেত্তে ওহমে-রাইনিকে মনে করেন, শীতল যুদ্ধের অবসানের পর থেকে সমাজ যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার বিষয়গুলোতে গুরুত্ব না দেয়ায় শান্তি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, "মানুষ এখন অনেক বেশি ব্যস্ত তাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো নিয়ে যেমন, মুদ্রাস্ফীতি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি এবং টিকে থাকার সংগ্রাম।”
তিনি মনে করেন, সেইসাথে আরও বেশি উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে আসা ব্যক্তি-নির্ভর মানসিকতা সামাজিক আন্দোলনগুলোকেও দুর্বল করে দিয়েছে।
"৬০ ও ৭০ এর দশকের মতো আর সেই পরিবেশ নেই,” বলেন তিনি। "মানুষ এখন সহজেই বিভ্রান্ত হয় এবং যে কোনও ইস্যুতে পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে পড়ে।”
মেরুকরণ কি শান্তিকে হত্যা করছে?
আন্নেত্তে মনে করেন, জার্মানির বিতর্ক সংস্কৃতিতেও একটি ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে, যেখানে মেরুকরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষ এখন অনেক বেশি চিন্তিত। যদি তারা শান্তি মিছিলে যোগ দেয় তবে তাদের কোনো রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হতে পারে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে কারণ এএফডি বা জার্মানির জন্য বিকল্প নামক ডানপন্থি দল রাশিয়ার প্রতি অপেক্ষাকৃত শান্তিবাদী মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে। আর ঐতিহ্যগতভাবে বামপন্থি শান্তি আন্দোলনের অনেকে এই দলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চান না।
ম্যুলার বলেন, অনিশ্চিত পৃথিবীতে যুদ্ধভীতি থাকা স্বাভাবিক। তবে সামরিক শক্তির বিকল্প তুলে ধরা জরুরি।
"যদি জার্মানির অস্ত্র কিনতেই হয়, তবে তা যেন প্রতিরক্ষামূলক হয়। আকাশ প্রতিরক্ষা, নজরদারি প্রযুক্তি, অথবা দ্রুত প্রতিরক্ষা বাহিনী পাঠানোর লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা,” বলেন তিনি।
বেন নাইট/জেডএ